বাংলাদেশে শান্তি, শৃঙ্খলা, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতরা। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এস তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে এই আশ্বাস দেন তারা।
তিস্তা চুক্তির ওপর জোর :এদিকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ওপর জোর দিয়েছেন পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ বিষয়ে জোর দেন।
বুধবার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।
বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন উলেস্নখ করেন, বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায়। তিনি আগামীতে আরও 'গণকেন্দ্রিক সম্পৃক্ততার' ওপর জোর দেন। তিনি বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির সমাপ্তি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জোর দেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে অত্যন্ত অতিরঞ্জিত মিডিয়া প্রচারের কথাও উলেস্নখ করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্য সম্পর্কে তিনি উলেস্নখ করেন, ভারত থেকে আসা এ ধরনের বক্তব্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার জন্য সহায়ক নয়।
ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে তার নতুন দায়িত্বের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তিনি প্রধান উপদেষ্টার প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শুভেচ্ছার উলেস্নখ করেন এবং উভয় দেশের জনগণের ভাগাভাগি আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আগামীতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য ভারত সরকারের গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রম্নতি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি উলেস্নখ করেন, সরকার সব ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা বা ভয়ভীতি সহ্য করা হবে না। তিনি যোগ করেন, সব ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে।
'সহায়তা করবে যুক্তরাজ্য'
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে শান্তি, শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে যুক্তরাজ্য। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার।
সাক্ষাৎ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, শান্তি, শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে যুক্তরাজ্য।
রাজনৈতিক আশ্রয়ের সিদ্ধান্ত স্ব-স্ব দেশগুলোর
এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে, তাদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্ব-স্ব দেশগুলোর।
বুধবার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে ইইউর ঢাকা মিশনের চ্যার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স ব্যান্ড স্প্যানিয়ার এ কথা জানান।
ইইউর ঢাকা মিশনের চ্যার্জ ডি অ্যাফেয়ার্সের কাছে এক সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা যদি অ্যাসাইলাম চায়, সেক্ষেত্রে ইইউর অবস্থান কী হবে
জবাবে ব্যান্ড স্প্যানিয়ার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কনসু্যলার সার্ভিস নেই। কেউ যদি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য সদস্য দেশগুলোর কাছে আবেদন করে তাহলে সেই রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে খুব ভালো আলোচনা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের সংকটকালীন সময়ে তাদের পাশে আছি। আমরা আজ (বুধবার) জানতে এসেছি, কীভাবে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করতে পারি।
বৈঠকে জিএসপি পস্নাস ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়নি বলেও জানান স্প্যানিয়ার। একই সঙ্গে ঢাকার বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোতে সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় ধন্যবাদ জানান তিনি।
'স্থিতিশীলতা দ্রম্নতই ফিরবে'
এদিকে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও শান্তি দ্রম্নতই ফিরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি দ্রম্নতই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরে আসবে। বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা উপভোগ করবে।
বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
এ সময় গতকাল বুধবার থেকে ঢাকার সৌদি আরব দূতাবাস পুনরায় বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা দেওয়া শুরু করেছে বলে জানান ইউসুফ আল দুহাইলান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বুধবার আমরা পুনরায় ভিসা দেওয়া শুরু করেছি। সৌদি দূতাবাস এখন সব ধরনের সেবা দেওয়া শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকাকালে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার ভিসা ইসু্য করা হতো।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও সৌদির মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা অর্থনৈতিক ইসু্য, ভিসা ইসু্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করেছি।
এ সময় বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদিতে অ্যাসাইলাম চেয়েছেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এরকম কিছু আমি শুনিনি।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না চীন
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
বুধবার দুপুরে অন্তর্র্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অতীতের ন্যায় উভয় দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করবে। আমরা একসঙ্গে আগামী বছর দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করব। এছাড়া আমরা রোহিঙ্গা ইসু্যসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি।
তিনি বলেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করবে চীন। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। চীন সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী চীন।
সহযোগিতায় প্রস্তুত মালয়েশিয়া
এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। আলাপকালে আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনর্গঠন ও পুনঃস্থাপনে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার কথা বলেছেন।
বুধবার নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
পোস্টে তিনি লেখেন, 'গতকাল আমি আমার পুরনো বন্ধু মোহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করেছিলাম; বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে তাকে অভিনন্দন জানাতে।'
আনোয়ার ইব্রাহিম আরও লেখেন, 'মালয়েশিয়ার সঙ্গে ইউনূসের দীর্ঘদিনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছি যে, মালয়েশিয়া বাংলাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনর্গঠন ও পুনঃস্থাপনে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে সাহায্য ও সমর্থন করতে প্রস্তুত।'
সংখ্যালঘুসহ সব বাংলাদেশির অধিকার রক্ষার আশ্বাস দেওয়ায় ইউনূসের প্রতি আমি খুব খুশি বলেও উলেস্নখ করেছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। দুই দেশের ভ্রাতৃত্ববোধের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে যত দ্রম্নত সম্ভব বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য ইউনূস আহ্বানও জানিয়েছেন, লেখেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।