পনেরো আগস্টের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার দেখা দিয়েছে উত্তাপ ও টানটান উত্তেজনা। দেশের প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতু্যবার্ষিকীতে ওইদিন ঢাকার ধানমন্ডিতে একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, দলটি যেন কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
দুই পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে দেশে আবারও সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেননা এমন একটি সময় এ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, যখন নিজেদের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হামলার শিকার হয়ে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ বাহিনী। পুলিশ কাজে যোগ দিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের কার্যক্রম খুবই সীমিত। ফলে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটি মোকাবিলা করা বর্তমান সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শোক দিবসের পূর্বপরিকল্পিত কর্মসূচি পালন করা অসম্ভব হওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার মাধ্যমে নেতাকর্মীর ঢল নামাতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য রাজপথে নেতাকর্মীর অবস্থানের মাধ্যমে শোক দিবস পালনে দলটির সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীকে নির্দেশও দিয়েছেন। গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীর মোবাইল ফোনে এ নির্দেশনা দেন। এক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'সবাই ঢাকায় চলে আসবে, মৌনমিছিল করে বঙ্গবন্ধু ভবনে ফুল দিতে হবে। বাংলাদেশের সব এলাকা থেকে ঢাকা এসে ফুল দিয়ে যাবেন। এ ছাড়া যাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের থানায় জিডি করতে হবে।'
আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেছেন, 'দলীয় সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তিনি শোক দিবসকে ঘিরে কর্মসূচি পালনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীতে শোক দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিতে ও একই সঙ্গে গত কয়েকদিনে সারাদেশে নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে আইনের আশ্রয় নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।'
এরই ধারাবাহিকতায় আজ ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কর্মসূচি পালনের নিরাপত্তা চেয়ে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ জানান, 'ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে আমি জেনেছি।'
জানা যায়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে, টুঙ্গিপাড়ার সমাধিসৌধে, বনানীতে ১৫ আগস্টে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা, মিলাদ মাহফিল, গণভোজের মাধ্যমে গণজমায়েত করবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।
এদিকে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে তৃণমূলের নেতারা শোক দিবস পালনে কর্মসূচি নিয়েছেন। অন্তত ১০ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে বাধা দিলে তা উপেক্ষা করেই পালন করা হবে। এ লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে, শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক ভিডিওবার্তায় শোক দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিতে নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানান। রোববার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, '১৫ আগস্ট আমার আহ্বান আপনাদের প্রতি, শান্তিপূর্ণভাবে ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দিয়ে আসবেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য, স্বাধীনতার চেতনার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।'
এ ছাড়া যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকেও ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে একাধিক ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
আ'লীগকে রুখতে মাঠে থাকবে ছাত্র আন্দোলন
এ অবস্থায় ১৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ ঢাকায় কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও সেটি সফল হতে দেবে না বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সংগঠনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুলস্নাহ বলেন, 'গত ১৬ বছর ধরে শাসনের নামে তারা যেভাবে মানুষের হত্যা, নির্যাতন ও গুম করেছে, যত রক্ত তাদের হাতে লেগে আছে, সেগুলোর বিচার না হওয়া পর্যন্ত এদেশের ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মাঠে দেখতে চায় না।' শেখ হাসিনা এবং তার দলকে বিচারের আওতায় আনতে বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠনের দাবি জানান এই সমন্বয়ক।
আব্দুলস্নাহ বলেন, 'বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠন করে তাদের বিচার করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সঙ্গে কথা বলব।'
কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনো বেশ বড় এবং নিষিদ্ধ কোনো সংগঠনও নয়। তাহলে তাদের দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না কেন?
এ প্রশ্নের জবাবে সমন্বয়ক আব্দুলস্নাহ বলেন, 'কারণ সুযোগ পেলেই তারা আবারও রক্তপাত ঘটাবে, মানুষের জীবন যাবে।' আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলেও দাবি করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আব্দুলস্নাহ বলেন, 'আন্দোলন চলাকালে তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়েছে, সেটা সবারই জানা। এরপর থানা থেকেও ওরা অস্ত্র লুট করেছে।' এ অবস্থায় তাদের আবারও রাজপথে নামার সুযোগ দিলে আবারও এদেশের মানুষের রক্ত ঝরবে, প্রাণ যাবে। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না।
রাজপথে নামতে না পেরে প্রশাসনের অনুগত কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
বিএনপিও আছে রাজপথে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ যখন মুখোমুখি অবস্থানে, তখন চুপচাপ বসে নেই বিএনপিও। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় নেতাকর্মী মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম বলেন, 'আমাদের নেতাকর্মী সব জায়গাতেই মাঠে আছেন। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন।' তবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালন করতে চাইলে তাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই বলে জানিয়েছে বিএনপি।
তিনি বলেন, 'নিবন্ধিত এবং বৈধ দল হিসেবে তারা অবশ্যই কর্মসূচি পালন করতে পারে। এটা তাদের অধিকার।'
তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ যেভাবে ফুঁসে উঠেছে, তাতে তারা শেষ পর্যন্ত নিরাপদে কর্মসূচি পালন করতে পারবেন কী-না সন্দেহ আছে।'
এ ছাড়া কর্মসূচি পালনের নামে মানুষের ওপর হামলা হলে বিএনপি সাধারণ নাগরিকদের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলেও জানিয়েছেন শামা ওবায়েদ।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ১৫ই আগস্টকে কেন্দ্র করে জাতীয় নির্বাচনের মতো ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু জাগ্রত ছাত্র-জনতা সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে।
অন্যদিকে জামায়াত, এলডিপি, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পাটি, গণসংহতি আন্দোলনসহ গত ১৫ বছর রাজপথে আওয়ামী লীেেগর বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রায় সব রাজনৈতিক দল আজ মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, ১৫ আগস্ট থেকে দলীয় কার্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে তাদের নেতাকর্মী অবস্থান নেবেন। বিভিন্ন স্পটে মিছিল ও সমাবেশ হবে। ঢাকাসহ সারাদেশে মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হবে। শুধু আজই নয় আগামী ২১ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে দলগুলোর।
এসব দলের নেতা মনে করছেন, ১৫ থেকে ২১শে আগস্টের মধ্যে আওয়ামী লীগ দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা লাগাতার রাজপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এ সময় দলগুলো মিছিল এবং সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। এসব কর্মসূচি সর্বদলীয় ঐক্যে, জনতার মঞ্চ কিংবা দলগুলোর দলীয় ব্যানারে করা হতে পারে।
এ ছাড়া ঢাবি ক্যাম্পাসে সক্রিয় ৩৪টি ছাত্র সংগঠনের গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৩৪টি ছাত্র সংগঠন। ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে ১৫ আগস্ট ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মুখোমুখি অবস্থানে সংঘাত সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরিন বলেন, 'দু'পক্ষ ঘোষণা দিয়ে যেভাবে মাঠে থাকার কথা বলছে, সেটি থামানো না গেলে আবারও সহিংসতা ও প্রাণহানি হতে পারে। কাজেই সরকারকে এখনই উদ্যোগী হয়ে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে হবে। দু'পক্ষের সঙ্গেই কথা বলতে হবে, থামাতে হবে।'
অন্যদিকে, পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাবে না বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'জনরোষের মুখে যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তাতে এখনই তারা রাজপথে কর্মসূচি পালন করবে বলে আমার মনে হয় না।' তবে পরিস্থিতি যদি সত্যিই খারাপের দিকে যায়, তাহলে সরকারের জন্য সেটি মোকাবিলা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন আহমদ।