'প্রতিবিপস্নব' ঠেকাতে চার দফা দাবিতে ফের রাজপথে নেমেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দিয়েছে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি 'রেজিস্ট্যান্স উইক'। যা শুরু হয়েছে রোডমার্চ দিয়ে।
মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। এরপর যেসব জায়গায় ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন সেসব পয়েন্ট অভিমুখে 'রোডমার্চ' কর্মসূচি পালন করেন তারা। রোডমার্চ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া, ফুলার রোড হয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং শহীদদের স্মরণে দোয়া প্রার্থনা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
চার দফার প্রথম দুই দফা ঘোষণা করে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, 'আমাদের আন্দোলনের এই রেজিস্ট্যান্স উইক কর্মসূচির দাবি চারটি। তার প্রথম দুই দাবি হলো- ফ্যাসিবাদী কাঠামো ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দল ও সরকার যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সেগুলোর দ্রম্নত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠন করতে হবে। দ্বিতীয় দাবিটি হলো- সংখ্যালঘুদের ওপর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী মহাজোটের শরিক দলগুলোর পরিকল্পিত হত্যা, ডাকাতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে গণ-অভু্যত্থানকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণকারীদের দ্রম্নত বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং সংখ্যালঘুদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে।'
সমন্বয়ক হাসনাত আবদুলস্নাহ বলেন, 'আমাদের তৃতীয় দাবি হলো- প্রশাসন ও বিচার বিভাগে যারা ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে হামলা, মামলা এবং হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বারবার কায়েমের চেষ্টা করছে, তাদের দ্রম্নততম সময়ে অপসারণ ও নতুন সরকারে তাদের নিয়োগ বাতিল করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। চতুর্থ দাবি হলো- প্রশাসন ও বিচার বিভাগে যারা এতদিন বৈষম্যের শিকার হয়েছে, তাদের জন্য দ্রম্নততম সময়ে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে হবে।'
শহীদ মিনারে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, 'আমাদের বিপস্নবকে নস্যাৎ করার জন্য প্রতিবিপস্নবের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এটিকে রুখে দিতে রেজিস্ট্যান্স উইক কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। আমরা ছাত্র-জনতা যে কোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে প্রস্তুত। আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের বিনিময়ে যে গণ-অভু্যত্থান হয়েছে সেই অভু্যত্থান আমরা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করব। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাসিবাদের দোসররা যতক্ষণ পর্যন্ত থাকবে, দেশের ছাত্র-জনতা ততক্ষণ পর্যন্ত রাজপথে অবস্থান করবে। আমাদের আগামীকালের কর্মসূচি সন্ধ্যার মধ্যে ঘোষণা করা হবে।'
আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, 'আমরা দেখেছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিভিন্ন জায়গায় কমিটি দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, আমরা এখনো এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমাদের আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। তাই আমাদের আন্দোলন সামনে এগিয়ে নিতে আপনারা চাইলে ভলান্টিয়ার কমিটি গঠন করতে পারেন। তবে সেখানে কোনো সমন্বয়ক বা সহ-সমন্বয়ক থাকবে না। সবাই ভলান্টিয়ার সেখানে। কমিটি ঘোষণা করব কি না সেটা আমরা পরে জানাব।'
আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের 'আগামীকাল সারাদিন- খুনিদের মামলা দিন', 'ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই- খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই', 'বিচার বিচার বিচার চাই-গণহত্যার বিচার চাই', 'আমার ভাই কবরে-খুনি কেন বাহিরে', 'দিয়েছি তো রক্ত-আরও দেব রক্ত', 'রক্তের বন্যায়-ভেসে যাবে অন্যায়', 'শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেব না' স্স্নোগান দিতে শোনা যায়।
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
এদিকে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে 'ষড়যন্ত্র' নস্যাৎ করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকতে সম্মত হয়েছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। নতুন সরকার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত 'পাল্টা অভু্যত্থানের' যেকোনো প্রচেষ্টা ঠেকাতে তারা একসঙ্গে মাঠে থাকার কথা বলেছে।
সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে অন্তর্র্বর্তী সরকারের দুই তরুণ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বৈঠক করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই দুই সমন্বয়ক ছাড়াও এর লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, খেলাফত ছাত্র মজলিসসহ অন্তত ২০টি ছাত্রসংগঠনের নেতারা অংশ নেন।
বৈঠক শেষে একাধিক নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একধরনের অঙ্গীকার ছিল, আন্দোলন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা (পস্ন্যাটফর্ম) ভেঙে দেওয়া হবে। সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারটিকে নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে একধরনের দ্বিধা-বিভক্তি তৈরি হয়েছে। তবে যেহেতু এখনো পাল্টা কিছু একটা ঘটানোর চেষ্টা আছে, তাই সবাই এই ব্যানারে আরও কিছুদিন ঐক্যবদ্ধ থাকার পক্ষে সম্মত হয়েছে। ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের ব্যানারে আলাদা মিছিল বা কর্মসূচি করা থেকে বিরত থাকবে। এই সময়সীমাটা কত হতে পারে, সে বিষয়ে বিভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ এক মাস, কেউ দুই মাস, কেউ তিন মাসের কথা বলেছে। ছাত্রসংগঠনগুলো একমত হয়েছে, অন্তর্র্বর্তী সরকার স্থিতিশীল হওয়ার আগপর্যন্ত সবাই একসঙ্গে মাঠে থাকবে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার স্থিতিশীল হওয়ার পর যে যার রাজনীতিতে ফেরত যাবে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ভেঙে দেওয়া হবে বলে উলেস্নখ করেন বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা। তারা আরও বলেন, এর আগপর্যন্ত তাদের নিয়মিত বৈঠক হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু তারা যে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে ছিলেন, তা শেষ হয়নি। ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের বিজয়ের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা নস্যাৎ করাই ছিল এই বৈঠকের আলোচনার বিষয়। আগামী বেশ কিছুদিন যেকোনো পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার বিষয়ে একমত হয়েছেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ১৫ আগস্ট কীভাবে পালিত হবে, সেদিন আগের মতো জাতীয় শোক দিবস থাকবে কিনা, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। বেশিরভাগ ছাত্রসংগঠন ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন না করার পক্ষে মত দিয়েছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
\হবৈঠকে অংশ নেওয়া ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, 'বলা হচ্ছে, ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের বিপরীতে আওয়ামী লীগ সামনে পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করতে পারে। সেটাকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি, তা নিয়ে বৈঠকে সব ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়েছে।'
ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতে পারবে কিনা, এ বিষয়েও আলোচনা উঠেছিল বলে বৈঠক সূত্র জানায়। এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করার ব্যাপারে সবাই মত দিয়েছেন।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের বিপরীতে যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সব ছাত্রসংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। এটি নিয়েই মূলত বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।