কাঁচাবাজারে স্বস্তি, অস্বস্তি মুদিপণ্যে
অর্ধেকে নেমেছে সবজির দাম ব্রয়লারের কেজি ১৬০ টাকা
প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
দীর্ঘদিন পর ক্রেতার নাগালের মধ্যে এসেছে সবজির দাম। মঙ্গলবার অধিকাংশ সবজি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। কিছু সবজি বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকারও নিচে। ঠিক এই দামে কবে সবজি কিনেছেন ক্রেতারা মনে করতে পারছেন না। সেইসঙ্গে কমেছে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দামও। সপ্তাহের ব্যবধানে যা প্রায় ৭০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। তবে অস্বস্তি রয়ে গেছে চালসহ অন্যান্য মুদিপণ্যের দামে। যদিও পাইকারি বাজারে অনেক পণ্যের দামই কমতির দিকে। এছাড়াও খাদ্যপণ্যের মজুতও পর্যাপ্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলবার রাজধানীর বাজারে অপরিবর্তিত দামে ছোট দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৩৬ টাকা দরে ও বড় দানার মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকার উপরে। একইভাবে মুগ ডালের কেজি ১৭০ টাকা, অ্যাঙ্কার ডাল ৮০ টাকা, ছোলা ১৪০ টাকা, চিনি ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। অপরিবর্তিত দরে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা, মোটা চাল ৫৭-৫৯ টাকা, মিনিকেট ৭০-৭২ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫-৮০ টাকা, আদা ৩০০-৩২০ টাকা ও রসুন ২০০-২২০ টাকা দরে। পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা দরে।
তবে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকেই পাইকারি বাজারে কমতির দিকে রয়েছে এসব মুদিপণ্যের দাম। কিন্তু তার প্রভাব নেই রাজধানীর বাজারে। দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, 'চলতি সপ্তাহের শনিবার থেকে বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতায় ফিরেছে। যেসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে কমছে। কারখানাগুলোয় উৎপাদন স্বাভাবিক ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলে ভোগ্যপণ্যের দাম আরো কমতে পারে।'
পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ফার্মগুলোর দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, এক সপ্তাহের মধ্যে পাইকারি পর্যায়ে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চিনির দাম প্রায় ৩০০ টাকা বেড়ে ৬ হাজার ৩০০ টাকায় উঠে যায়। তবে শনিবার পর্যন্ত চিনির দাম বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা কমে লেনদেন হয়েছে। পাম অয়েলের মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) দাম ২০০-২৫০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। সোমবার পণ্যটির দাম মণপ্রতি ৫০ টাকা কমে ৪ হাজার ৯৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে সয়াবিনের মণপ্রতি দাম ৫০-৭০ টাকা, সুপার পাম অয়েলের মণপ্রতি দাম প্রায় ১০০ এবং গমের দাম মণপ্রতি ৪০-৫০ টাকা কমেছে। তবে সব ধরনের ডাল ও চালের দামও এখনো অপরিবর্তিত বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, গত সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হওয়া মোটা মসুর ডাল কেজিপ্রতি ৫-৬ টাকা বেড়ে ১২৮ টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে মটর, ছোলা, মুগসহ বিভিন্ন ডালজাতীয় ভোগ্যপণ্য স্বাভাবিকের চেয়ে কেজিপ্রতি দুই-আড়াই টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে লেনদেন হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, 'ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনে সমস্যা, পরিবহণ সংকট ও নিরাপত্তার অভাবে পাইকারি বাজারে
ভোগ্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকগুলোয় কয়েক দিন ধরে নগদ উত্তোলনে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে পাইকারি বাজারের লেনদেন অনেক কমে যায়। এতে নগদে পণ্য ক্রয়ে বাড়তি দাম হাঁকছেন ব্যবসায়ীরা। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় লেনদেন কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। একই কারণে অধিকাংশ পণ্যের দাম নিম্নমুখী। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন শতভাগ স্থিতিশীল হলে ভোগ্যপণ্যের দাম আরো কমে আসবে বলেও জানান তারা।
এদিকে রাজধানীর বাজারে অনেকটাই কমেছে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম। এদিন প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, সোনালি ২৭০ টাকা ও লেয়ার ৩১০ টাকা দরে। অর্থাৎ সপ্তাহ ব্যবধানে দাম কমেছে ৫০-৭০ টাকা পর্যন্ত। তবে অপরিবর্তিত দরে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা দরে।
অন্যদিকে মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দু-এক পদের সবজি ছাড়া বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকার নিচে। সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির অতিরিক্ত খরচ গুনতে না হওয়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছে সবজির বাজারে। নাগালের মধ্যেই পাওয়া গেছে সব ধরনের সবজি। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বাজার সিন্ডিকেট না থাকালে আর চাঁদাবাজি না হলে সবজির দাম আরো কমবে।
এদিন বাজারে প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যা শীতের ভরা মৌসুমেও বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকার উপরে। একইভাবে এক সপ্তাহ আগে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি কাঁকরোল এদিন বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা, পেঁপে ৩০, পটল ৩৫ টাকা, শশা ৪০ টাকা, ঢেঁড়স ৩৫-৪০ টাকা, লম্বা বেগুন ৫০ টাকা, কচুর মুখি ৫০ টাকা, করলা ৬০ টাকা।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন ঠিক কবে এই দামে সবজি কিনেছেন মনে করতে পারছেন না। সবজির দাম এত বেশি ছিল যে আধা কেজির বেশি কোনো সবজি তারা কিনতেন না। এখন ১০০ টাকায় আধা কেজি করে ৪-৫ পদের সবজি কিনছেন ক্রেতারা। সবজি বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে এখন কোনো সিন্ডিকেট নেই। নেই চাঁদাবাজিও। তাই সবজির দাম অনেক কম। এর মধ্যেই আমাদের মুনাফাও হচ্ছে আগের মতোই। আর ক্রেতারাও খুশি।
তবে এখনো নাগালের বাইরে রয়েছে অনেক সবজি। এর মধ্যে গোল বেগুন ৮০-১০০ টাকা, টমেটো ১৫০ টাকা, গাজর ১৬০ টাকা, ক্যাপসিকাম সবুজ ২২০ টাকা, ক্যাপসিকাম লাল ও হলুদ ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে বাজারে কোনো সরবরাহ সংকট নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও সরকারি গুদামেও রয়েছে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যর মজুত। এর মধ্যে প্রধান খাদ্যশস্য চালের মজুত চার মাসে দেড় গুণেরও বেশি বেড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে চালের মজুত এখন প্রায় ১৩ লাখ টন। এর সঙ্গে ধান ও গম মিলিয়ে খাদ্যশস্যের মোট মজুত দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ টনেরও বেশিতে।
দেশে খাদ্যশস্যের বর্তমান মজুতকে 'সন্তোষজনক' মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, চাল উৎপাদন ভালো হওয়ায় নূ্যনতম প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সরকারি মজুত রয়েছে। এ কারণে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় বেগ পেতে হবে না।
অন্যদিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও সচল হয়েছে। ফলে পণ্যের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ সংকটের কোনো শঙ্কা আপাতত নেই। এ কারণে চাল আমদানিরও কোনো প্রয়োজন পড়বে না। তবে মসলাপণ্য ও সার আমদানির জন্য বিকল্প উৎস তৈরির পাশাপাশি ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৮ লাখ ৯ হাজার ৮৫৭ টন। এর মধ্যে চাল মজুত রয়েছে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন। গম মজুত ছিল ৪ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৩ আর ধান মজুত ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ২১৮ টন। ধানকে চাল আকারে মোট মজুতে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছে।
গত এপ্রিলেও দেশের সরকারি গুদামগুলোয় চালের মোট মজুত ছিল ৮ লাখ ৭৭ হাজার টন। এদিকে গত রবি মৌসুমে দেশে গম উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৯৮ হাজার টন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ লাখ ২৮ হাজার টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি গম উৎপাদন হয়েছিল।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'নূ্যনতম ১২ লাখ টন চালের মজুত থাকা লাগে। সে হিসেবে আমাদের মজুত এখন বেশি আছে। গত বোরো মৌসুমে উৎপাদন বেশি হওয়ায় মজুত বেড়েছে। ৩০ আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে। ফলে অভ্যন্তরীণ মজুত আরো বাড়তে পারে। এতে আগামী আমন মৌসুম পর্যন্ত চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। আর বাজার নজরদারি জোরদার করলে চালসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যেরও দাম কমতে পারে। কারণ আগের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এখন অনেকটাই নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তবে উৎপাদন ও মজুতের তুলনায় দাম এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি। মূলত সরবরাহ সংকটে এমনটা হয়েছে। এখনো পণ্য পরিবহণ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে দাম স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'