কক্সবাজারের টেকনাফে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডসহ বেশকিছু ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় প্রস্তাবনার ১৩ বছর পর নতুন করে আলোচনায় আসে পুলিশে সংস্কারের বিষয়। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার পর এ ইসু্যটি আবারও ধামাচাপা পড়ে। এবার কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ফের ইমেজ সংকটের পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ায় পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে সদস্য সবাই একযোগে নতুন করে সংস্কারের দাবি তোলে। এর পরপরই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে কোথায় আটকে আছে 'পুলিশ সংস্কার প্রস্তাব'।
এরই মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পর রোববার প্রথম কার্যদিবসেই পুলিশ সংস্কারের প্রতিশ্রম্নতি দিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশ বাহিনীকে এমনভাবে সংস্কার করা হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সরকারই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে। তার ভাষ্য, 'পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে, এটা যাতে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ব্যক্তি, এমনকি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ব্যবহার করতে না পারে সে ধরনের আইন, সে ধরনের ব্যবস্থা করা হবে।' তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, পুলিশ চলবে পুলিশ কমিশনের অধীন। এই পুলিশকে জনগণের পুলিশ করে গড়ে তোলা হবে।
প্রসঙ্গত, পুলিশকে আরও জনবান্ধব ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ওই সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এসএম শাহজাহানের নেতৃত্বে একটি কমিটি পুলিশ সংস্কারের খসড়া অধ্যাদেশ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পরে বিভাগ, জেলা ও উপজেলার তৃণমূল পর্যায় থেকে জনমত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও অধ্যাদেশটি আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা প্রসঙ্গটি প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহের সময় নানা মহলে আলোচনায় উঠলেও তা আর এগিয়ে নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন মহলে কথা বলে যেটি পাওয়া যায়, তা হলো এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্নটি দেখেন তারা। তারা বলেন, প্রশাসন মনে করে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে পুলিশকে মাত্রাতিরিক্ত
ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাতে পুলিশে মন্ত্রণালয়ের 'খবরদারি' কমে যাবে। একই সঙ্গে পুলিশে রাজনৈতিক প্রশাসনের হস্তক্ষেপে লাগাম টানা হয়েছে ওই অধ্যাদেশে। ফলে অধ্যাদেশটির বিষয়ে এই দুই পক্ষই আন্তরিক নয়।
পুলিশের এক সাবেক আইজি এ প্রসঙ্গে বলেন, এ আইনটি কেন এখনো পাস হয়নি, সেটা অনেকেরই প্রশ্ন। তবে আইনটি পাস হওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভূমিকাই প্রধান বলে জানান তিনি।
এদিকে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুলিশ অধ্যাদেশ পাস হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে আমলারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা তাদের ইচ্ছামতো পুলিশের পদায়ন, বদলি ও নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। মূলত তাদের কারণে পুলিশ অধ্যাদেশটি দীর্ঘদিনের পাস হয়নি। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন। পুলিশ অধ্যাদেশ পাস হলে সেই সুযোগ থাকবে না রাজনৈতিক নেতাদের।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও মনে করেন, এ অধ্যাদেশ পাস হলে পুলিশের ওপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমে আসবে। তাই তারা চান এটি দ্রম্নত পাস হোক। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা মনে করেন, এটি পুলিশকে আরও বেশি পেশাদার বাহিনীতে রূপান্তর করবে। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকায় আইনের শাসন কায়েম করা সহজ হবে।
পুলিশের অ্যাডিশনাল এসপি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বেশকিছু স্পটে পুলিশ বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে। নিয়মবহির্ভূত প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এজন্য রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশের গুটি কয়েক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাই দায়ী। অথচ যার খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা পুলিশ প্রশাসনকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালেই পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। যা গণঅভু্যত্থানে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অধস্তনরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তাদের জন্য পুলিশের আজকের এ অবস্থা। তারা পুলিশের মতো একটি শৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছেন। তারাই পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। চিহ্নিত সেসব কর্মকর্তা বাংলাদেশ পুলিশের দুই লাখ সদস্যকে মৃতু্যর মুখে ফেলে নিজেরা পালিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, শেষ মুহূর্তেও মাঠে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন তারা। এজন্যই পুলিশের এত সদস্য ক্ষুব্ধ জনতার হাতে নির্মমভাবে মারধরের শিকার হয়ে মৃতু্যবরণ করেছেন।
কী আছে পুলিশ সংস্কার প্রস্তাবে: ব্রিটিশ আমলে ১৮৬১ সালে প্রণীত আইন দিয়ে চলছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। বর্তমান বাস্তবতায় ঔপনিবেশিক আমলের বিধিবিধান কার্যকর নয় বলেই মনে করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত জনগণকে শাসন করার মানসিকতা থেকেই প্রণীত হয়েছিল ১৮৬১ সালের আইনটি। ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে তা থেকে বেরিয়ে আসার একটা চেষ্টা আছে; পুলিশকে সেবাদানকারী সংগঠনে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক চাপে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত কাউকে দুই বছরের আগে বদলি করা যাবে না। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা যে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির মৌখিক, লিখিত বা টেলিফোনে সুপারিশ ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
বিদ্যমান আইনে গুলির ব্যবহারসহ এ ধরনের ঘটনায় তদন্ত করার এখতিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশ হেফাজতে কারও মৃতু্য হলে তা আইনসঙ্গত ছিল কি না তা তদন্ত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এসব ক্ষেত্রে খসড়া প্রস্তাবে ১১ সদস্যের জাতীয় পুলিশ কমিশন, ৫ সদস্যের স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে দ্রম্নত সাজা দেওয়ার জন্য পুলিশ ট্রাইবু্যনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ এবং ইউনাইটেড ন্যাশন্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি ২০০৭ সালের মে মাসে কাজ শুরু করে। পরে তারা একটি খসড়া সংস্কার আইন জমাও দিয়েছিল। কিন্তু সেই সংস্কার প্রস্তাবনাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনও এক কক্ষের ফাইল কেবিনেটে এখন বন্দি হয়ে আছে। কমিটির পক্ষ থেকে একটি খসড়া অধ্যাদেশও প্রণয়ন করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নে কখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা এ নিয়ে কখনও কোনো সরকারকে চাপ দেয়নি। বরং প্রস্তাবিত সংস্কার আইনটি বাস্তবায়ন না হলেও সময়ের প্রয়োজনে প্রতিনিয়তই সংস্কার হচ্ছে- এমন দাবি করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ইউএনডিপির সহায়তায় খসড়া প্রণয়ণ কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সেটি এক যুগেরও বেশি সময় আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (পুলিশ) নেতৃত্বে একটি যাচাই-বাছাই কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেটার সর্বশেষ কী অবস্থা আর জানা যায়নি। এখনো সে অবস্থাতেই আছে বলে জানান তারা। কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশ পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়, যেহেতু মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, জনগণের অধিকার সংরক্ষণ, সংবিধান ও আইন অনুসারে কর্মপরিচালনা এবং জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণে পুলিশের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ভূমিকা রয়েছে। পুলিশকে পেশাগতভাবে দক্ষ, সেবা নিবেদিত, জনগণের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন, বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত এবং আইন, আদালত ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জ, আইনের শাসন ও সুশাসনের নীতি বিবেচনা করে পুলিশের ভূমিকা, কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনঃসংজ্ঞায়িত করা সমীচীন। দক্ষতার সঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ, উদ্ঘাটন ও দমন, জন শৃঙ্খলা শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য পুলিশ পুনর্গঠন প্রয়োজন।
পুলিশ পুনর্গঠনে অধ্যাদেশ প্রণয়নের যৌক্তিকতা তুলে ধরে খসড়া আইনে আরও বলা হয়, যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ একটি অতি পুরনো পুলিশ আইন নিয়ে চলছে। যা আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য উপযুক্ত নয়। উপনিবেশিক আমলে পুলিশ ছিল প্রভুদের সেবাদাস। আর স্বাধীনতা উত্তরকালে গত কয়েক যুগ যাবৎ রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা অবৈধ প্রভাবের মাধ্যমে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছে। পুলিশ সার্ভিসের ভিতরে ও বাইরে পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের অসন্তোষ ও মোহমুক্তি এখন স্বীকৃত বিষয়। ক্ষমতাসীনদের অবৈধ যন্ত্র থেকে রূপান্তর করে জনগণের সেবায় নিবেদিত একটি পুলিশ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে অতীতে পুলিশ সার্ভিসের মুখ্য উদ্দেশ্য 'জনগণের সেবা করা' থেকে বিচু্যত হয়েছিল বলে মনে করে পুলিশ পুনর্গঠন কমিটি। তাই বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন পুলিশ আইন প্রয়োজন। পুলিশের কাজ হচ্ছে দেশের জনগণের সেবা করা, ক্ষমতাসীনদের নয়। শক্তি প্রয়োগ থাকবে নূ্যনতম। আইন প্রয়োগের নামে নানা বেআইনি উপায়ের ব্যাপক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়ের মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ সার্ভিসে পেশাদারিত্ব সংরক্ষণে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও সম্পর্কিত ভিত্তিতে মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। কাজের ভিত্তিতে পুলিশের মূল্যায়ন হবে।