ঢাকায় পুরোপুরি শুরু হয়নি থানার কার্যক্রম
কিছু থানার কার্যক্রম শুধু জিডি নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, থানার ভেতরে পোড়ানো গাড়ির স্তূপ
প্রকাশ | ১২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
ম যাযাদি রিপোর্ট
এখনো পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হয়নি ঢাকার ৫০ থানায়। কোনো কোনো থানার কার্যক্রম স্বল্পপরিসরে শুরু হয়েছে। তবে তা জিডি নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সরকার পতনের পর ঢাকার থানাগুলোয় সহস্রাধিক যানবাহন ভাঙচুরের পর পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা। এসব যানবাহন বেশিরভাগ পুলিশের। বাকিগুলো থানায় জরুরি কাজে যাওয়া মানুষের। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মিরপুর মডেল থানা ও যাত্রাবাড়ী থানা ভবনকে। থানায় পোশাকধারী কোনো পুলিশ সদস্য নেই। সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। সরেজমিন বিভিন্ন থানায় গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র।
মিরপুর মডেল থানা: রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার চারদিকের দেওয়ালের অধিকাংশই ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া দেওয়ালের মাঝখান দিয়ে লাগানো স্টিল ও লোহার গ্রিল খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। লুটে নেওয়া থানার কোনো জিনিসপত্র ফেরত পাওয়া যায়নি। সেগুলোর কোনো হদিস মিলছে না বলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান।
ভেঙে ফেলা হয়েছে থানার সামনের সাইনবোর্ড। থানার প্রবেশের পর বামদিকে থাকা কাঠ আর কাঁচ দিয়ে তৈরি চেকপোস্টটি ভাঙচুরের পর তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু ওপরের ছাদ ছাড়া কিছুই নেই। সামনে একটি এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনার ক্যারিয়ার) পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিনতলা থানা ভবনটির সব কক্ষ ভেঙে চুরমার করে তাতে আগুন দেওয়া হয়েছে। থানার সামনে থাকা পুলিশের অন্তত ৫০টি মোটর সাইকেল পুড়ে গেছে। আর থানার প্রবেশ পথেই পড়ে আছে অন্তত শতাধিক পুলিশ সদস্যের পোশাক ও জুতো। যার অধিকাংশই পুড়ে গেছে।
থানার সামনে থাকা ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত) ও পরিদর্শকসহ (তদন্ত) টহলে ব্যবহৃত পিকআপ গাড়িগুলো পুড়ে কঙ্কাল হয়ে হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৫
পড়ে আছে। থানার পশ্চিম দিকে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত মেট্রো বেকার্সের হোটেলটি পুরোপুরি ভাঙচুর করে তাতে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে সেটি। থানার পশ্চিম দিকে ও পেছনে থাকা অন্তত ২০টি বড় গাড়ি ও প্রাইভেটকার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। থানার পেছনে বিশাল গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। সব মিলিয়ে থানাটিতে অন্তত একশ' যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৫০টি মোটর সাইকেল ছাড়া বাকিগুলোর মধ্যে আছে পুলিশের পিকআপ, থানায় সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষের ৪টি প্রাইভেটকার, এপিসিসহ নানা ধরনের যানবাহন।
থানাটির চারদিকে অন্তত ৬ ফুট দেওয়াল ছিল। তার ওপর ছিল কাঁটাতারের বেড়া। হামলা ও অগ্নিসংযোগের সময় প্রাণে বাঁচতে পুলিশ সদস্যরা নিজেদের পুলিশের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাকে কাঁটাতারের বেড়া কেটে পশ্চিম দিকের দেওয়াল ডিঙিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। থানার প্রাচীরের মধ্যে সামনের দিকে একটি গোল ঘরে কয়েকজন পুলিশ পস্নাস্টিকের চেয়ার ফেলে বসে আছেন। তাদের মধ্যে তিন নারীও আছেন। তারা নিজেদের পুলিশ সদস্য বলে জানান। তবে নিজেদের নাম ও পদবি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন। বলেন, থানাটির পুরো তিনতলা পর্যন্ত আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
আগুনে থানার ভেতরে থাকা সব মালামাল, মামলার নথিপত্র পুরোপুরি পুড়ে গেছে। শুধু যেসব মামলার চার্জশিট বা প্রতিবেদন আদালতে দেওয়া হয়েছে, সেসব মামলা বা প্রতিবেদনের কপি পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া কোনো কিছুই থানা থেকে আর কোনো দিনই পাওয়া সম্ভব নয়। থানার কার্যক্রম চলার বিষয়ে জানতে চাইলে সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলেন, শুধু থানায় জিডি নেওয়ার কার্যক্রম সচল আছে। জিডির ফরম ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে আনা হয়েছে। এ ছাড়া চুরি, ডাকাতিসহ অন্য অপরাধের ঘটনায় মামলা দায়ের করার কোনো কার্যক্রম চালানোর কোনো সুযোগ নেই। থানাটি কবে নাগাদ চালু হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সদস্যরা বলেন, সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও থানার কার্যক্রম চালু হতে অনেক সময় লেগে যাবে।
পুরো ভবনটি কালো হয়ে আছে। ভবনের সামনে ছোট করে সাদা কাগজে লেখা রয়েছে 'ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, ভেতরে প্রবেশ নিষেধ'। থানার গেটের বাইরে ও ভেতরে সেনা সদস্যদের পাহারা দিতে দেখা গেছে।
দারুস সালাম থানা : মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের মাঠ লাগোয়া একটি ছয়তলা ভাড়া বাড়িতে দারুস সালাম থানা অবস্থিত। থানার সামনেই অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি পোড়া মোটর সাইকেল পড়ে আছে। আর থানার মূল গেটের সামনেই পড়ে আছে থানা থেকে লুট হওয়ার পর উদ্ধার হওয়া আলমারিসহ বিভিন্ন স্টিলের আসবাবপত্র। ছয়তলা পর্যন্ত ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। থানাটিতে আগুন দিলেও দ্রম্নততার সঙ্গে নেভানো সম্ভব হয়। যে কারণে পুরোপুরি ভবনটি পুড়ে যায়নি। তবে থানার ভেতরে থাকা বিভিন্ন আসবাবপত্র ও মামলার সব নথিপত্র পুড়ে গেছে। বাইরে সেনা সদস্যদের পাহারা দিতে দেখা গেছে।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল প্রায় শতাধিক পুলিশ সদস্যের পোশাক আর জুতো। সেখানে পরিদর্শক থেকে শুরু করে কনস্টেবল সবারই পোশাক আছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানাটিতে যথন হামলা হয়, তখন পুলিশ সদস্যরা নিজেদের পোশাক খুলে সাধারণ পোশাকে, অনেকে খালি গায়ে আবার অনেকেই শুধু প্যান্ট আর গেঞ্জি পরিধান করে ভবনটির দরজা জানালা ভেঙে আশপাশে লাগোয়া বাসায় গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। এ ছাড়া অনেক পুলিশ সদস্যরা ছাদে ওঠে পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করেছেন।
থানাটিতে ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদস্যকে দেখা গেছে। তারা সাধারণ পোশাকে থানায় অবস্থান করছেন। তাদের গায়ে কোনো পুলিশের পোশাক নেই। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, থানাটিতে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমনকি জিডি পর্যন্ত নেওয়ার মতো অবস্থায়ও নেই। আতঙ্কে অধিকাংশ পুলিশ সদস্যরা থানায় আসছেন না। থানার ভেতরে সেনা সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া থানার বাইরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা থানার ভেতর থেকে পুড়ে যাওয়া ও ভাঙচুরের কারণে অচল হয়ে পড়া মালামাল এবং থানার ভেতরে জমে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করে তা গাড়িতে তুলছেন।
থানার সামনে অন্তত ২০টি স্টিলের আলমারি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পুলিশ সদস্যরা জানান, এগুলো থানা থেকে লুট হওয়া মালামাল। স্থানীয় জনগণ ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনো লুট হওয়া অনেক মালামাল উদ্ধার হয়নি। লুট করা মালামাল বিক্রির দায়ে একজনকে আটকও করা হয়েছে।
দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া ওই ব্যক্তি থানার মালামাল লুট করে উত্তরার একটি ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দোকানদার সেগুলো লুটের মালামাল বুঝতে পেরে আর কেনেননি। পরে তারা স্থানীয় জনতা ও ছাত্রদের খবর দেয়। এ সময় উত্তেজিত জনতা ওই লুটকারীকে মারধর করে। গণধোলাইয়ের সময় লুটকারীর ডান পা ভেঙে দেয় জনতা। পরে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।
শেরেবাংলানগর থানা : থানাটির বাইরে সেনাসদস্যরা পাহারায় রয়েছেন। গেটে আনসার সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে প্রচুরসংখ্যক সদস্য সেখানে অবস্থান করছেন। এটি ঢাকার অন্যতম নিরাপদ জায়গায় থাকা থানাগুলোর একটি। বাহির থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই থানার ভেতরে কী ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। অনেকটাই 'বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট' অবস্থা।
সেনা সদস্যদের অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চক্ষু চড়ক গাছ। থানার সামনে সারিবদ্ধ করে রাখা ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত) ও পরিদর্শক (অপারেশন্স) ছাড়াও টহল কাজে নিয়োজিত ৩টিসহ মোট ৬টি পিকআপ ভাঙচুরের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। থানাটির সামনে থাকা অন্তত ১০টি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া থানার ভেতরে পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁষে থাকা ১০ থেকে ১২টি মোটর সাইকেল, দুটি প্রাইভেটকার, পুলিশের টহল পিকআপগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি পিকআপ মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব বলে থানার পশ্চিম দিকে থাকা গাড়ি মেরামতকারীদের ধারণা।
থানার পূর্বদিকে দুটি দামি প্রাইভেটকার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি দুটিতে করে জরুরি কাজে থানায় এসেছিলেন তারা। গাড়ির মালিকরা আত্মরক্ষা করতে পারলেও গাড়ি রক্ষা করতে পারেননি। সেখানে দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানায় কোনো ধরনের কার্যক্রম চলছে না। সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্যকে থানার ভেতরে সাধারণ পোশাকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তবে তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন।
থানাটির পুলিশ সদস্যদের ভাষ্য, ঢাকার অন্যান্য থানার তুলনায় এ থানাটিতে ধ্বংসযজ্ঞ তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। কারণ থানাটি একটি সুরক্ষিত জায়গায় অবস্থিত। এ ছাড়া থানাটির আশপাশে কোনো আবাসিক এলাকা বা জনবসতি নেই। জনবসতি থাকলে হয়তো ধ্বংসযজ্ঞ আরও বেশি হতো। এ ছাড়া থানাটি নতুনভাবে শেরেবাংলানগরে হওয়ার কারণে অনেকেই থানাটি চেনেন না। এ ছাড়া থানাটিতে যাওয়ার তেমন কোনো সাইনবোর্ড আশপাশের কোনো রাস্তায় নেই। একটি বহুতল সরকারি ভবনের পেছনে থানাটির অবস্থান। সামনে না যাওয়া পর্যন্ত থানাটি চেনার কোনো উপায় নেই। হঠাৎই বাহির থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বড় গাছের ডালে থানার মূল সাইনবোর্ডটি ঢেকে আছে। এতে সহজেই ভবনটি থানা নাকি অন্য কোন স্থাপনা তা সামনে না গেলে বোঝা যায় না। যে কারণে থানাটিতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ তুলনামূলক কিছুটা কম হয়েছে।
তেজগাঁও মডেল থানা : তেজগাঁও থানার গেট পুরোপুরি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে মূল গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। থানাটির ভেতরে কাউকেই প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। এমনকি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো সেবাগ্রহীতার দেখা মেলেনি। যদিও থানাটিতে কোনো ধরনের হামলা, ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। তারপরও সারাদেশের অধিকাংশ থানাগুলোয় যে ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে, এতে পুলিশ সদস্যরা চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
থানার এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাস্তবিক অর্থে থানায় তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। আর লোকজনও থানায় আসছেন না। থানাটিতে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই যোগদান করেছেন। তবে তারা সাধারণ পোশাকে এসে যোগদান করেছেন। আতঙ্কের কারণে তারা থানায় অবস্থান করছেন না। থানা থেকে কোনো ধরনের মালামাল খোয়া বা চুরি যায়নি বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। থানাটির পাশাপাশি সেখানে থাকা উইমেন পুলিশের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ থানা কম্পাউন্ডের ভেতরেই উইমেন পুলিশের অফিস।
শাহবাগ মডেল থানা : থানায় কোনো সেবা প্রার্থীর দেখা মেলেনি। থানার গেট তালা দেওয়া। সেখানে অবস্থান করছে সেনা সদস্যরা। এ ছাড়া ভেতরে রয়েছেন আনসার সদস্যরাও। থানার একটি চেয়ার-টেবিলও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটনা ঘটেনি। অথচ শাহবাগ থানার সামনেই আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিক্ষোভ চলেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান ভেনু্য শাহবাগ থানা এলাকার মধ্যে অবস্থিত। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটির রাজু ভাস্কর্য, শাহবাগ চৌরাস্তা মোড়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মরণকালের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দুর্বৃত্তরা। অথচ যেটি সত্যিই খুবই বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা বলছেন থানাটির দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা জানান, অন্যান্য থানায় যখন ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, ওই সময় থানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কে নিজেদের পোশাক খুলে নিরাপদে চলে যান। তাদের পালাতে পর্যন্ত হয়নি। পরে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ হত্যাসহ ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কারণে থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এজন্য অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুধু থানায় জিডি করার কাজ চলছে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যেহেতু শাহবাগ থানার অধীন, তাই কলেজটির মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে কাজ করছে শাহবাগ থানা পুলিশ। এ ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম আপাতত পরিচালিত হচ্ছে না। কারণ পুরোপুরি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাপোর্ট বা জনবল লাগে তা আপাতত নেই। যে কারণে কার্যত থানাটি কার্যত অচল পড়ে আছে। কারণ কোনো মামলা হচ্ছে না। আসামি হিসেবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। গ্রেপ্তারের পর ওই আসামিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। সেসব কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে থানার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তবে আশা করা হচ্ছে, হয়তো স্বল্প সময়ের মধ্যেই কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে।
উত্তরা পূর্ব থানা: রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় সরেজমিন দেখা যায়, থানার সামনে মেইন রোডে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে একটি এপিসি আগুনে পোড়া অবস্থায় কংকাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। থানার মেইন গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে আরও চার-পাঁচটি গাড়ি পোড়া স্টিল বডি পড়ে আছে। থানা ভবনে আগুনে পোড়ার ছাপ রয়ে গেছে। তিনতলা বিশিষ্ট ভবনটিতে একটি কক্ষ ব্যবহারের উপযোগী নেই। এই ভবনটি ব্যবহার করতে হলে পুরো ভবনটি সংস্কার করতে হবে। থানার নিরাপত্তা ও পুলিশ সদস্যদের কাজে ফেরাতে কাজ করছেন সেনাবাহিনী। সেনাবহিনীর সঙ্গে আনসার সদস্যরাও।
সরেজমিন উত্তরা পূর্ব থানা ঘুরে সেনাসদস্য ও আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আতঙ্ক এখনো কাটেনি। পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ সিভিল ড্রেসে থানায় এসে খাতার স্বাক্ষর করে চলে যাচ্ছেন।
উত্তরা পূর্ব থানার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্য সার্জেন্ট আনোয়ারুল যায়যায়দিনকে বলেন, 'থানায় মোট ১৩৫ পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ১১৫ পুরুষ এবং ২০ জন নারী। পুলিশের সব অস্ত্র সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছে। এ ভবনে থানার কার্যক্রম চালু করতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে। এখনো কোনো কাজে হাত দেওয়া হয়নি। ভবন মেরামত না করে এখানে কোনো ধরনের কাজ সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, আজ কয়েকজন অভিযোগ নিয়ে এলেও আমরা রাখতে পাচ্ছি না। কারণ আমাদের কাগজপত্র রাখার কোনো জায়গা নেই। পুলিশের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা তাদের পাশে কাজ করছি।
খিলক্ষেত থানা: সরেজমিন দেখা যায়, ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে সহিংসতায় থানাটির বেশিরভাগ কক্ষ পুড়ে গেছে। থানা চত্বরে থাকা গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার কাগজপত্র, নথি, চেয়ার-টেবিল সব পুড়ে ভস্মীভূত।
খিলক্ষেত থানা আনসার সদস্য রিফাত, রুবেল ও সেনাসদস্য মাসুদ যায়যায়দিনকে বলেন, পুরো থানায় বসার কোনো ব্যবস্থা নাই। থাকার কোনো ব্যবস্থাও করা হয়নি। পুলিশ সদস্য আসছে আর যাচ্ছে। কাজ এখনো শুরু হয়নি। কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। তবে কবে নাগাদ সম্পূর্ণ থানার কার্যক্রম শুরু হবে সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। সেনাসদস্য ১০ জন, ব্যাটালিয়ন ৭ ও আনসার সদস্য ১৭ জন এখানে ডিউটি করছে। থানার নিরাপত্তায় আমরা কাজ করছি।
রামপুরা থানা : সরেজমিন রামপুরা থানায় গিয়ে দেখা যায়, মেইন রোড থেকে গলির ভিতরে কয়েকটি পুলিশের গাড়ি লাইন করে রাখা হয়েছে। কয়েকটি গাড়িতে আগুনে পোড়ার চিহ্ন আছে। থানা ভবনে কোথাও আগুনে পোড়ার চিহ্ন নেই। পুলিশ সদস্যরা এখনো থানায় আসেনি। কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। সেনা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা থানায় অবস্থান করতে দেখা যায়।
এলাকাবাসী জনান, থানার পাশে মসজিদ থাকায় থাকায় থানা ভবনে আগুন দেয়নি। এতে রক্ষা পেয়েছে রামপুরা থানা। তবে পুলিশ সদস্যরা কেন কাজে আসছে না সে সস্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
রামপুরা থানায় দায়িত্বরত ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য হেমায়েতুলস্নাহ যায়যায়দিনকে বলেন, 'এ থানায় কোনো হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের কোনো সদস্য এখনো কাজে আসেনি। আজ থেকে থানার কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। হয়তো আজকালের মধ্যে সবাই এসে পড়বে। এ থানায় এখনো কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি।