সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

পুলিশকে কাজে ফিরতে ৪ দিনের আলটিমেটাম

বৃহস্পতিবারের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ না দিলে পলাতক ঘোষণা, 'চাঁদাবাজি করলে পা ভেঙে দেওয়া হবে' ্বপুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো, কোনো মিডিয়া চাটুকারিতা করলে বন্ধ করে দেওয়া হবে

প্রকাশ | ১২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
এম সাখাওয়াত হোসেন

কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, 'পুলিশের যেসব সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, তাদের জন্য শেষ সময় হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার ১৫ আগস্ট। এর মধ্যে যদি কেউ যোগ না দেন, তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা চাকরি করতে ইচ্ছুক নন। তাদেরকে পলাতক ঘোষণা করা হবে।' রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় পুলিশ সদস্যদের দ্রম্নত কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এর আগে বুধবার আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম ৮ আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যে সব ইউনিটের সদস্যকে কাজে যোগদান করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর পুলিশ সদস্যরা ধীরে ধীরে কাজে ফিরতে শুরু করে। তবে এখনো তারা পুরোপুরি মাঠে নামেননি। জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন এক মাসের মাথায় সহিংস রূপ নেয়। তারপর তা পরিণত হয় সরকারপতনের আন্দোলনে। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এই আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতায় তিন শতাধিক মানুষের মৃতু্য হয়েছে, যাদের অনেকে শিক্ষার্থী। আবার সরকার পতনের আগে সংঘর্ষে এবং সরকার পতনের পরে থানায় থানায় হামলায় বহু পুলিশ সদস্যও হতাহত হন। এর পর পুলিশি ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। নিরাপত্তাসহ ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন নন ক্যাডার পুলিশ সদস্যরা। পুলিশহীন রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে নামানো হয় আনসার। রাতের ঢাকা পরিণত হয় ডাকাত আতঙ্কে এক ভয়ের নগরীতে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, 'বৃহস্পতিবারের (১৫ আগস্ট) মধ্যে আপনারা (পুলিশ সদস্য) কাজে যোগদান করুন। এই সময়ের মধ্যে যারা যোগদান করবেন না, তাদের চাকরিচু্যত করা হবে। যা কিছু ঘটেছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। তদন্ত অনুযায়ী বিচারবিভাগ বিচার করবে। এতে কারোর ভয় পাওয়ার কিছু নাই। নির্দোষ কেউ কোথাও কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।' এম সাখাওয়াত হোসেন জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, 'পুলিশের গায়ে কেউ হাত দেবেন না। পুলিশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন নিশ্চয়। ডাকাতি হচ্ছে বা ডাকাতির ভয় পাচ্ছেন। বোঝার চেষ্টা করুন, পুলিশের প্রয়োজন রয়েছে।' 'চাঁদাবাজি করলে পা ভেঙে দেওয়া হবে' বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'আমি কোনো রাজনীতিবিদ না। একজন ফৌজ, যা বলি তাই করার চেষ্টা করি। আপনারা কেউ চাঁদাবাজি করবেন না। দখলবাজি করবেন না। যদি চাঁদাবাজি করেন তাহলে পা ভেঙে দেওয়া হবে।' তিনি বলেন, 'দেশের একটি রাজনৈতিক দলের কী করুন অবস্থা হয়েছে, তা আপনারা দেখেছেন। যাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত, তাদের অবস্থা দেখেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা বিশেষ পরিস্থিতি দেশে তৈরি হয়েছে। তার সুযোগ আপনারা নিচ্ছেন, এটা বন্ধ করেন। আমার কাছে খবর আসছে, কাওরান বাজারে চাঁদাবাজি, একটি ব্যাংকে ঢুকে গোলাগুলি করে দখলের চেষ্টা হচ্ছে। এভাবে চলবে না।' জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'চাঁদাবাজদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করুন। নিজেরা আইন হাতে তুলে নেবেন না।' পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে এদিকে, সরকার পতনের আন্দোলনের আগে ও পরে সহিংসতায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে সোমবার ঢাকার কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। বিগত সরকারগুলোর আমলে বাংলাদেশে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে তা 'অত্যন্ত বেদনাদায়ক'। আবার পুলিশও কিছুই করেনি, বিষয়টি এমন নয়।' তিনি বলেন, 'একজনকে গুলি করে মারা, আরেকজনকে মাথার চামড়া তুলে ফেলা বা হাত-পা টুকরো করে ফেলা, মাথা থেঁতলে দেওয়া, এটা তো আপনি কারও সঙ্গে করতে পারেন না। এমনকি যুদ্ধের সময় একজন মৃত সৈনিককে এভাবে থেঁতলে দিই না। এটা দুঃখজনক। এটাও দুঃখজনক যে হাজার তরুণ মারা গেছে পুলিশের গুলিতে।' উপদেষ্টা বলেন, 'পুলিশের হাতে আধুনিক মারণাস্ত্র দেখে আশ্চর্য হয়েছি। পুলিশকে ব্যবহার করেছেন লাঠিয়াল বাহিনীর মতো। এই পুলিশকে তৈরি করেছে, তাদের হাতে মারণাস্ত্র দেওয়া হয়েছে। তাদের হাতে আমি সেসব অস্ত্র দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। এটা মনে হয় ১৫-২০ বছর আগে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র আছে তা শত্রুকে মারার জন্য। এটা পুলিশকে দেওয়া ঠিক হয়নি।' এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'পুলিশ না থাকায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে 'নানা অপকর্মের খবর' পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ ছাড়া আমাদের সমাজ চলতে পারে না। আপনারা দেখছেন, আমরা প্রতিদিন খবর পাচ্ছি, বলে স্যার আমার বাড়ি লুট হচ্ছে। তারপরও কি করব, কিছু করার নাই, আমি শুনে যেতে পারি। সেনাবাহিনীকে বলেছি তারা বের হয়ে আছে, বিজিবি আছে.. এটা তাদের কাজ না। পুলিশের কাজ সেনাবাহিনী করতে পারে না, তবুও তারা করছে।' তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে যা হয়ে এসেছে, একটা রাষ্ট্রের রাজনীতিতে তা হয় না। একজনের ইচ্ছেমতো রাষ্ট্র চালানো যায় না। সেটা যাই হোক। যার অবদানই থাক, এটা বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল ঠিকই, কিন্তু হাজার হাজার লোক যুদ্ধ করে, ত্রিশ লাখ লোক মারা যাওয়ার পর এই রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে। এই রাষ্ট্র পার্সোনাল প্রপার্টি না। আমি খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছি কারও পার্সোনাল প্রপার্টি না। কারও ফ্যামিলি প্রপার্টি না।' বিগত সরকারের সমালোচনা করে অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বলেন, 'রাজনীতিকে এত নষ্ট করা হয়েছে যে আর কেউ এটা করতে পারে না। বাপ ছেলে, ছেলের বউ, নাতিপুতি চলতেই আছে। পাওয়ারকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। হাজার হাজার লোক মারার পরও পাওয়ারে থাকতে চায়। এটা খুবই দুঃখজনক।' যারা চাটুকারিতা করবে সেসব মিডিয়া বন্ধ হবে কোনো মিডিয়া চাটুকারিতা করলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, 'বিগত সরকারের সহিংসতা নিয়ে গণমাধ্যমগুলো অনেক মিথ্যাচার করত। তারা সরকারের চাটুকারিতা করেছে। মিডিয়া সঠিক তথ্য তুলে ধরলে আজ এত পুলিশ মারা যেত না। একটা দেশ ডোবে যখন, মিডিয়া তখন মিথ্যা প্রচার করে।' ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'আগে যা হয়েছে, নতুন করে কাউকে চাটুকারিতা করতে দেওয়া হবে না। মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এরপরও যারা চাটুকারিতা করবে, সেসব মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে।' সহিংসতায় ৪২ পুলিশ নিহত : আইজিপি রাজধানীর পল্টনে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে চিকিৎসাধীন পুলিশ সদস্যদের খোঁজখবর নেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। এ সময় তিনি বলেন, 'কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৪২ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনর্ যাব সদস্য রয়েছে। এ ছাড়া বহু আহত রয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালেই ৫০৭ জন চিকিৎসা নিয়েছে। এ ছাড়া হামলায় গুরুতর আহত ২৭ জন পুলিশ সদস্য ভর্তি রয়েছেন। যার মধ্যে একজন আইসিইউতে আছেন। আহতদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। পাশাপাশি আহতদের পরিবারকে মানসিকভাবে সাপোর্ট ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছি।'