ছাত্র-জনতার গণঅভু্যত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, দখলের ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের অধিকাংশ জায়গায়ই পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই। যে কারণে রাত জেগে পাড়া-মহলস্নায় পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় জনগণ। এমনকি প্রতিটি পাড়া-মহলস্নায় গঠন করা হয়েছে শৃঙ্খলা কমিটি।
গত ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এছাড়া চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুরসহ অনেক জায়গায় গণডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই তৎপর হয়ে উঠছে অপরাধীরা। ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনী, স্থানীয় জনতা, ছাত্র, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের হাতে অন্তত কয়েকশ' অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে যানবাহনে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অনেককেই।
ঢাকার বিভিন্ন মহলস্নার লোকজনের সঙ্গে কথা
বলে জানা গেছে, ঢাকাবাসী চোর-ডাকাতদের ভয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত। বিশেষ করে ডাকাতদের ভয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। অনেকেই ভয়ে সন্ধ্যার পর বাসা থেকে নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না। ডাকাত আতঙ্কে বাড়ির মালিকরা অপরিচিত কাউকে বাসার ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করেছেন। বাড়ির কেয়ারটেকারদের এ ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকেই বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে এমনকি পাড়া-মহলস্নায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই দোকানপাট একপ্রকার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি মার্কেটের সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ডাকাত আতঙ্কে। যেসব মার্কেটে আগে পাহারা দেওয়া হতো না- সেসব মার্কেটেও পাহারা দেওয়া হচ্ছে। আর যেসব মার্কেটে আগে থেকেই পাহারা ছিল সেখানে পাহারাদারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন দেখা গেছে, রাত ৮টার পর থেকেই প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায়-মহলস্নায় মহলস্নায় ছাত্র, যুবক, তরুণ, মাঝ বয়সি নারী-পুরুষও পাহারা দিচ্ছেন। তারা পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। অজানা আতঙ্কের পাশাপাশি ডাকাতদের ভয়ে এমন রাত জেগে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির মালিক সমিতির তরফ থেকেও গঠন করা হয়েছে নিরাপত্তা কমিটি। এছাড়া চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে প্রতিটি পাড়ায় শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হচ্ছে পাড়া-মহলস্নার আয়তনের ওপর ভিত্তি করে। পালাক্রমে চার ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টা পর পর শিফট বদল হয়ে পাহারা দিতে দেখা গেছে ঢাকার মিরপুরের কল্যাণপুর, পাইকপাড়া, পীরেরবাগ, ৬০ ফুট, জনতা হাউজিং, ইবনে সিনা হাসপাতালের আশপাশের মহলস্নাগুলোতে।
রাত জেগে পাহারা দিতে গঠিত কমিটিতে থাকা অধিকাংশজনই পুরুষ। যাদের বয়স ৫০ এর বেশি নয়। তবে অনেকেই ছাত্র-জনতার সঙ্গে শখ করেও রাত জেগে পাড়া-মহলস্নায় পাহারা দিচ্ছেন। এছাড়া শিশুরাও পাহারা দিচ্ছে বড়দের দেখাদেখি। কোনো কোনো কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ২০০ থেকে ৩০০ জনও আছে। প্রতি শিফটে ৩০ থেকে ৪০ জন করে দলবেঁধে বা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পাহারা দিচ্ছে। তাদের হাতে দেখা গেছে লাঠি আর বাঁশি। যখনই কোন চোর বা ডাকাত বলে সন্দেহ হচ্ছে তখনই একযোগে বাঁশি বাজানো হচ্ছে। এছাড়া মাঝে মধ্যেই বাঁশি দেওয়া হচ্ছে। যাতে করে ডাকাত বা চোর বা অপরাধীরা কোন ধরনের অপরাধ করার উদ্দেশ্যে পাড়া-মহলস্নায় প্রবেশের সাহস না পায়।
পাইকপাড়া আদর্শ আবাসন এলাকার পাহারাদার জামাল মিয়া বলছিলেন, আগে রাত ১০টা থেকে ডিউটি শুরু হতো। বর্তমানে রাত ৮টা থেকেই ডিউটি করতে হচ্ছে। কারণ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এজন্য দুই ঘণ্টা আগ থেকেই ডিউটি করতে হচ্ছে। আগে রাত ১১টার দিকে আবাসিক এলাকাটির সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাত ৮টার পরই সব গেট বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। যদিও প্রতিটি গেটেই চাবি নিয়ে একজন করে পাহাদার থাকেন। শুধুমাত্র মূল গেট ছাড়া সব গেট বন্ধ রাখতে বাড়ির মালিকরা নির্দেশ দিয়েছেন। রাতে অপরিচিত কোনো ব্যক্তিকে মহলস্নায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে তিনি যার কাছে এসেছেন তাকে এসে নিয়ে যেতে হবে। কারণ মোবাইল ফোনেরও বিশ্বাস নেই। অন্য কাউকে মোবাইল ফোনে কথা বলিয়ে দিয়ে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতে পারে।
কল্যাণপুর নতুনবাজারের পাহারাদার ইলিয়াস জানান, বিকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কেটের চার দিকের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি চুরি ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন কঠোর অবস্থানে নিতে হয়েছে। আর দোকানিরাও সন্ধ্যা নামার আগেই দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছেন। শুধুমাত্র দোকানিদের বের হওয়ার রাস্তা রাখা হচ্ছে। তবে কাউকেই মার্কেটের ভেতরে সন্ধ্যার পর ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ির একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানাটির বিভিন্ন গ্রামে চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেছে। এজন্য তারা গ্রামের শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করে রাতের পর রাত পাহারা দিচ্ছেন। যাতে করে কোনো ধরনের চুরি-ডাকাতি না হতে পারে। পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন গ্রামবাসীরা। সব ধর্ম-বর্ণ ও রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে সবাই একত্রে সম্মিলিতভাবে চুরি-ডাকাতি, হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ-লুটপাট ঠেকাতে এভাবেই প্রতিটি রাতে পাহারার ব্যবস্থা করেছেন।
টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বী অধু্যষিত ভাতকুড়া, সেনবাড়ি, সিংগাটা, হারিনাতেলী, কেন্দুয়া, নলস্ন্যাসহ আশপাশের প্রতিটি গ্রামে ও ধনবাড়ি পৌরসভার প্রতিটি মহলস্নায় শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করে রাতে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ পাহারা বসানো হয়েছে মন্দিরগুলোকে ঘিরে। মন্দিরগুলোর সামনে স্থায়ী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাকাটিতে কয়েকশ' মন্দির রয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের সামনে দিনেও পাহারা দেওয়া হচ্ছে। তবে পাড়া-মহলস্নায় শুধুমাত্র রাতে পাহারার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ঢাকার পাইকপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হোসেন বলছিলেন, ঢাকার অনেক এলাকায় চুরি-ডাকাতি হচ্ছে। এজন্য রাত জেগে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো এলাকা পাহারা দিতে গঠন করা হয়েছে তিনটি দল। দলগুলো পালাক্রমে রাত জেগে মহলস্না পাহারা দিচ্ছে। দলের বেশিরভাগ সদস্যই ছাত্র। এছাড়া অন্যান্য বয়সি মানুষও আছেন। তবে দীর্ঘ সময় এভাবে পাহারা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হতে পারে। কারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে তারা যথারীতি ক্লাসে ফিরে যাবে। এর মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ ওর্ যাব পুরোপুরি নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলে আর হয়তো তেমন সমস্যা হবে না। যদিও এমন ক্রান্তিকালেওর্ যাব তাদের নিরাপত্তা অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় রাতের্ যাবের টহল চোখে পড়ে।