ছাত্র-জনতার তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে যে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল তা পুনর্গঠনে কাজ শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ২৯ থানায় সেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। তবে সেনা পাহারা থাকলেও এক ধরনের অস্বস্তি নিয়েই পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ তারা এতদিন পালন করেছেন, এখন সেসব কর্মকর্তা নেই। অন্যদিকে, এদিন বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিটের পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে মাঠপর্যায়ের সাধারণ পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফিরে পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজধানীর যেসব থানায় হামলা হয়নি বা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব থানায় এদিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- গুলশান, তেজগাঁও, রমনা, কলাবাগান, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, সূত্রাপুর, ডেমরা, গেন্ডারিয়া, মতিঝিল, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর, শেরেবাংলা নগর, হাতিরঝিল, শাহ আলী, কাফরুল, ভাষানটেক, দারুসসালাম, রূপনগর, ক্যান্টনমেন্ট, বনানী, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরখান ও বিমানবন্দর থানা।
এদিকে যেসব থানায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, সেসব থানায় পুলিশ সদস্যরা এলেও কাযক্রম শুরু হয়নি। ফলে ডিএমপির ২১ থানার কার্যক্রম শুরু হয়নি।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও থানার কার্যক্রম শুরু হয়। থানার নিরাপত্তায় পুলিশের পাশাপাশি সেনা সদস্যরা কাজ করছেন, সঙ্গে দেখা গেছে আনসার সদস্যদের।
থানার কার্যক্রম শুরুর আগে তেজগাঁও থানা পুলিশের সহায়তায় স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করে সেনাবাহিনী। সাধারণ মানুষ থানার কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর ২৫ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানি অধিনায়ক শাখাওয়াত খন্দকার।
তিনি বলেন, 'আমরা স্থানীয়দের চিনি না। পুলিশের সহায়তায় সমাজের গ্রহণযোগ্য ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তেজগাঁও থানা এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি।'
তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, 'প্রথমে আমি স্মরণ করি, বিগত দিনে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি, এরকম অনেক সদস্য এখন নেই। এখন আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। পুলিশে আমি আজ ২৩ বছর। একসঙ্গে কাজ করেছি, কিছুদিন আগেও আমার থানায় ছিল এখন তিনি নেই। আসলে আমার পুরো পুলিশ সদস্য পরিবার, সত্যিকারভাবে আমরা ট্রমাটাইজড। তার মধ্যেই আমরা জনগণের প্রয়োজনেই কাজ করি। আমাদের ব্যর্থতা আমরা অনেক সময় জনগণকে বোঝাতে পারি না। আজকেও ফিরে আসা জনগণের জন্যই। জনগণ প্রয়োজন বোধ করেছে, পুলিশ না থাকলে কী হচ্ছে, সেই প্রয়োজনেই ফিরে আসা।'
ওসি মহসীন বলেন, 'জনগণকে বলব, আমাদেরকে আস্থায় নেওয়ার জন্য। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এটা অস্বীকার করব না যে, আমাদের ভুল বা ব্যর্থতার জন্য আজকের এই অবস্থা। এগুলো ওভারকাম করে আগামী দিনে সত্যিকারের মানুষের প্রয়োজনে যাতে এই বাহিনী থাকতে পারে, আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে এই সেবাগুলো অব্যাহত রাখার চেষ্টা করব।'
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক বলেন, 'সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। মানুষের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আজ আমরা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় পুলিশের সব কার্যক্রম শুরু করেছি। সব নাগরিকের কাছে অনুরোধ আপনারা থানায় আসুন। আপনাদের সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত।'
কার্যক্রম শুরু হলেও তেজগাঁও থানায় উপস্থিত হয়েছেন অল্প কয়েকজন সদস্য, বাকিরা এখনো আসেননি। যারা এসেছেন তারাও আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ভীত। কর্মস্থলে এসেছেন পরিচয় গোপন করেই।
উপ-কমিশনার আজিমুল বলেন, 'তেজগাঁও বিভাগে ৬টি থানার মধ্যে ৩টি থানার কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত থানার স্বল্প পরিসরে কাজ চলছে। এরই মধ্যে থানাগুলোতে অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। বাকিরাও আসতে শুরু করেছেন।'
গুলশান থানার এসআই মামুন মিয়া জানান, শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত পারিবারিক ঘটনায় থানায় একটি জিডি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, তীব্র গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। নির্বিচারে আক্রমণ হতে থাকে থানায়, ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়।
এসব হামলায় বহুসংখ্যক পুলিশ হতাহত হলে অন্যরা নিরাপদে সরে যেতে থাকেন। এতে করে দেশে এই প্রথমবার নজিরবিহীন পুলিশবিহীন অবস্থা তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে, শুক্রবার পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ডিঅ্যান্ডপিএস-১) বেলাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পুলিশের সব ইউনিটের পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, আপনার ইউনিট/অধীন ইউনিটে প্রশাসনিক কারণে সাময়িক বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্যদের (কনস্টেবল থেকে এসআই/সমপদমর্যাদা এবং ডিএমপির ক্ষেত্রে পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদা পর্যন্ত) সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এই নির্দেশনা আদালতের আদেশ এবং ফৌজদারি মামলাজনিত কারণে সাময়িক বরখাস্ত পুলিশ সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ডিঅ্যান্ডপিএস-১) বেলাল উদ্দিন বলেন, প্রশাসনিক কারণে সাময়িক বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্যদের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে মামলাজনিত কারণে সাময়িক বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্যদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।