শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

জামালপুর-চট্টগ্রাম কারাগারে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে গুলি, ৬ বন্দি নিহত

যাযাদি রিপোর্ট
  ১০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
জামালপুর-চট্টগ্রাম কারাগারে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে গুলি, ৬ বন্দি নিহত

শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই নরসিংদীর কারাগার থেকে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ জন কয়েদি পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের প্রতিটি কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এরপরও গত কয়েকদিনে শেরপুর, কুষ্টিয়া, কাশিমপুর ও সাতক্ষীরা জেল ভেঙে বিপুল সংখ্যক বন্দি পালিয়েছে। যাদের একটি বড় অংশ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এ নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ-আতঙ্কের মধ্যেই জামালপুর জেলা কারাগার ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার অভ্যন্তরে তান্ডব চালিয়ে বন্দিরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে এই দুই কারাগার থেকে কোনো বন্দি পালাতে পারেনি। এ সময় জামালপুর কারাগারের ৬ বন্দি নিহত হন।

যায়যায়দিনের জামালপুর প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে বন্দিরা জামালপুরে জেলা কারাগারের জেলারসহ কারারক্ষীদের জিম্মি করে ফটক ভেঙে পালানোর চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সময় বন্দি আরমান, রায়হান, শ্যামল, ফজলে রাব্বি বাবু, জসিম ও রাহাত নিহত হন। তাদের সবার বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলায়। এ ঘটনায় আহত হন জেলারসহ অন্তত ১৯ জন।

জামালপুর জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃতদের সরকার মুক্তি দেয়। এর সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে ৩০/৪০ জন বন্দি তাদের মুক্তির দাবিতে বিদ্রোহ শুরু করে। এতে বন্দিরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি করে। এর মধ্যে বিদ্রোহী গ্রম্নপের বন্দিরা কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জেলারের কাছে এসে কারা ফটকের চাবি চায়। এ সময় জেলার আবু ফাত্তাহ কয়েদিদের চাবি দিতে না চাইলে বন্দিরা তার ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে তাকে জিম্মি করে কারাগারের ভেতরের ফটক ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে পার্শ্ববর্তী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা থেমে থেমে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে কারাগারের অভ্যন্তরে জেলারের অফিস কক্ষ, বিভিন্ন ওয়ার্ড এবং কারা হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ করে বন্দিরা। আগুনের ধোয়ায় পুরো কারাগার এলাকা ছেয়ে যায়। এ সময় বিদ্রোহী বন্দিরা বাকি কারারক্ষীদের ওপরও হামলা করে তাদের জিম্মি করে ফেলে। কারাগারে হট্টগোল এবং গুলির শব্দ পেয়ে কারাগারের নিকটবর্তী অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকা সেনাবাহিনী এগিয়ে এসে কারাগারের চারপাশ ঘিরে ফেলে। এ সময় কারাগারের ভেতর থেকে কিছু বন্দি 'বাঁচান' 'বাঁচান' বলে চিৎকার করতে থাকেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে কারাগারের দেয়ালের ওপর দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানো চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ সময় মাইকিং করে কয়েদিদের শান্ত থাকা ও পালিয়ে না যাওয়ার জন্য আহ্বান জানায়।

এদিকে বিদ্রোহী বন্দিদের হাতে দুই ঘণ্টা বন্দি থাকার পর বেশ কয়েকজন বন্দির সহযোগিতায় জেলার আবু ফাত্তাহ আহত অবস্থায় বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে সেনাবাহিনী,র্ যাব, পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বিকাল থেকে সন্ধ্যার পর কারাগারে বিদ্রোহী বন্দিদের কাছে জিম্মি থাকা ৩ নারীসহ ১৩ কারারক্ষীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে রুকনুজ্জামান (৫০), সাদেক আলী (৪৫) ও জাহিদুল ইসলাম (৪১) নামে তিন কারারক্ষী বন্দিদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছে এবং একজন গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

জামালপুর কারাগারের জেলার আবু ফাত্তাহ জানান, কারা বন্দিদের মধ্যে যারা বিদ্রোহে অংশ নেয়নি তাদের জিম্মি করে ও নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় ৫ বন্দি ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন বন্দির মৃতু্য হয়। বিদ্রোহের প্রায় ১০ ঘণ্টা পর মধ্যরাতে জামালপুর জেলা কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে কর্তৃপক্ষ। বিদ্রোহের ঘটনায় জেলারসহ ১৩ কারারক্ষী ও ৫ জন বন্দি আহত হয়। আহতদের বেশ কয়েকজন কারারক্ষীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বাকিদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে আহতদের মধ্যে ৩ কারারক্ষীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে একজনকে ইতিমধ্যেই ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। কারাগার ও মর্গের বাইরে বন্দিদের স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠা নিয়ে ভিড় জমিয়েছে। জেলার আরও বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া বন্দিদের মৃতু্য কারণ এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না এবং ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরও সম্ভব নয়। এই কারাগারে ৬৬৯ জন কারাবন্দি ছিল। তবে কোনো রাজনৈতিক বা জঙ্গি আসামি বন্দি নেই আর কয়েদিদের কেউ পালাতে পারেনি।

এদিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও বন্দিদের বিদ্রোহ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে কারারক্ষীসহ বেশ কয়েকজন কয়েদি আহত হন। তবে কোনো কয়েদি পালাতে পারেনি।

আমাদের চট্টগ্রাম বু্যরো অফিস জানায়, শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে থেমে এক ঘণ্টা কারা অভ্যন্তরে চলে গোলাগুলি। পরে সেনাবাহিনীসহ কারারক্ষীরা রাবার বুলেট ছুঁড়েন এবং ফাঁকা গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

চট্টগ্রাম কারাগারের জেল সুপার জানান, জুমার নামাজের পর কিছু কয়েদি পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এ সময় কারাগারে পাগলা ঘণ্টা বাজানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কোনো আসামি পালিয়ে যায়নি বলে দাবি করেন তিনি। চট্টগ্রাম কারাগারে মৃতু্যদন্ডাদেশ পাওয়া শতাধিক আসামি ছাড়াও জঙ্গি, কুকি-চিনসহ বিভিন্ন মামলার কয়েক হাজার আসামি রয়েছে।

কারাগারের গেটের দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান, দুপুরে নামাজের পর হঠাৎ কারাগারের একাধিক ভবনে কয়েদিরা বিদ্রোহ শুরু করে। এ সময় কারারক্ষীরা ফাঁকা গুলি চালায়। এতে বেশ কয়েকজন বন্দি আহত হন।

লালদিঘীর পার এলাকার বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীর জানান, দুপুর থেকে কারাগারে ভেতর থেকে ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। বাইরে থেকেও কিছু মানুষ কারাগারের প্রধান ফটক ভাঙার চেষ্টা করেন। নামাজের পর হঠাৎ কারাগারের ভেতর থেকে বিকট আওয়াজ আসে। এ সময় লালদীঘির চারপাশে রাস্তা-ঘাটে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম জেল সুপার মঞ্জুর হোসেন বলেন, বিদ্রোহ শুরু হলে কারাগারে পাগলা ঘণ্টা বাজানো হয়। এখন পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কতজন আহত হয়েছেন তা এখনো বলা যাচ্ছে না। কারাগারের ভেতরে সেনাবাহিনী রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবসময় কারাগারে সেনাবাহিনী রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. ইব্রাহিম বলেন, 'বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। কারাগারে সেনাবাহিনী ও বিজিবি পৌঁছেছে। একজন বন্দিও পালাতে পারেনি। এ ঘটনা কেন ঘটেছে সেটি আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি।'

এর আগে গত ৫ আগস্ট বিকালে কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ ও কারারক্ষীরা হামলা প্রতিরোধ করেন। বর্তমানে কারাগারে প্রায় ৪ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছে। কারাবন্দিদের রাখার জন্য পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ভবনের প্রতিটিতে বন্দি রাখার ধারণ ক্ষমতা ৩০০ জন। সাংগু, কর্ণফুলী ও হালদা ভবনের প্রতিটিতে বন্দি রাখার ধারণ ক্ষমতা ২৪০ জন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে