ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর রাজধানীসহ সারাদেশের সব থানা পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। একে একে পুলিশের সব ইউনিটের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। নিরাপত্তাহীনতায় কর্মবিরতি ঘোষণা করে পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি সংগঠন। তবে এসবের মধ্যেই সদ্য দায়িত্ব নেওয়া পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম পুলিশের সব ইউনিটের সদস্যকে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেন। বৃহস্পতিবার পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরতে দেখা গেছে। তাদের আসার পথে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্রছাত্রী এবং আপামর জনসাধারণ যাতে পুলিশ সদস্যরা নিরাপদে কর্মস্থলে আসতে পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন।
এর আগে পুলিশ সদস্যরা তাদের কর্মস্থলে ফিরতে নানা বাধার মুখে পড়ছেন বলে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। তবে তা সত্য নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বৃহস্পতিবার সকালে এক বার্তায় বলা হয়, 'পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে আসার
পথে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন মর্মে যে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে, সেগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি। সুতরাং গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করা হলো।'
কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হওয়া পুলিশ সদস্যদের রাজনীতিক, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণির মানুষ সহযোগিতা করছেন বলে বার্তায় জানানো হয়েছে।
ছাত্র-জনতার বিপুল গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। নির্বিচারে আক্রমণ হতে থাকে থানায়, ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়।
এসব হামলায় বহুসংখ্যক পুলিশ হতাহত হলে অন্যরা নিরাপদে সরে যেতে থাকেন। এতে করে এমন নজিরবিহীন অবস্থা তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাসহ বেশিরভাগ সদস্য। যে কারণে মঙ্গলবার সকাল থেকে থানাগুলো ছিল পুলিশশূন্য ও অরক্ষিত।
শেখ হাসিনার সময় দায়িত্ব পাওয়া আইজিপি চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুনকে চাকরি থেকে সরিয়ে সেই পদে মো. ময়নুল ইসলামকে দায়িত্বে আনার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় মঙ্গলবার রাতে।
পরদিন নতুন আইজিপি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ব স্ব ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপরই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার ছয়টি থানায় দায়িত্বরত পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণকে সেবা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন।
এসএমপির উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) বিএম আশরাফ উলস্নাহ তাহের বলেন, 'পুলিশের দায়িত্বে ফিরে আসার খবরে সেবাপ্রার্থী লোকজনও থানাগুলোতে যাতায়াত শুরু করেছেন।'
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট নগরের মীরের ময়দান পুলিশের পোশাকবিহীন অবস্থায় অধস্তন কয়েকশ কর্মকর্তা-কর্মচারী পুলিশ সংস্কার পস্ন্যাটফর্মের ব্যানারে বিক্ষোভ করেন।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিহত-আহত পুলিশ সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেন তারা।
সম্প্রতি পুলিশ লাইন্সে হামলার সময় কোনো ধরনের নির্দেশনা ছাড়াই ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান বলেও অভিযোগ তোলেন তারা।
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে তারা বলেন, আমরা দেশবাসীর শত্রম্ন হতে চাই না, জনগণের বন্ধু হতে চাই। আমরা দেশবাসীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের হয়ে কাজ করতে চাই। রাজনৈতিক মন্ত্রী-এমপিদের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে অনেক দালাল পুলিশ অফিসার আমাদের যেমন খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করেছেন।
বক্তারা বলেন, এসব দলাদলিতে আমরা থাকতে চাই না। পুলিশ বাহিনীর দালালদের কারণে আমরা এবং আমাদের পরিবার এখন অনিরাপদ। আপনারা দেখেছেন, কীভাবে অনেক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এসব ছাত্রদের কাজ না।
সে সময় তারা 'বিসিএসের দালালি, চলবে না চলবে না', 'মন্ত্রীদের দালালরা, হুঁশিয়ার সাবধান', 'আমার ভাই মরল কেন, জবাব চাই জবাব চাই, এমন বিভিন্ন ধরনের স্স্নোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষত অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সার্বিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন।
তবে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হেড কোয়ার্টার, ডিবি কার্যালয় ও আশপাশের থানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সবগুলো কার্যালয় পুলিশের সদস্য সংখ্যা কম ছিল। দুপুর ১টার দিকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান এই কার্যালয়ের মূল ফটকে সেনাবাহিনী ও স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন) নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। কার্যালয়ে ডিবি সংশ্লিষ্ট অফিসার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়া আর কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে যারা সেখানে ঢুকছেন, সবাইকে পরিচয় নিশ্চিত করে প্রবেশ করতে হচ্ছে।
মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনের সড়কে, যেখানে ডিবির সারি সারি গাড়ি পার্ক করে রাখা হতো, বৃহস্পতিবার সেখানে একটি গাড়িও দেখা যায়নি। মিন্টু রোডের দুই পাশে শুধুই নীরবতা। সেখানে দায়িত্বে থাকা ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, কার্যালয়ে আপাতত ডিবির অফিসার ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সবাইকে পরিচয় নিশ্চিত করে প্রবেশ করতে হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একই দৃশ্য দেখা গেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরেও। প্রবেশপথে তেমন কোনো মানুষ নেই। সেখানে সেনাবাহিনী বা এসপিবিএন সদস্যদের কাউকেও দেখা যায়নি। সিভিল পোশাকে পুলিশের সদস্যরাই গেটে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। যারা ভেতরে প্রবেশ করছেন, তাদের ইউনিফর্ম ছাড়া সাধারণ পোশাকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তাদেরও গেটে পরিচয় নিশ্চিত করে ভেতরে যেতে হচ্ছে।
দপ্তরের প্রধান ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানান, কিছু কিছু কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসে অবস্থান করছেন। বেশিরভাগই এখনো আসেননি।
দুপুর দেড়টার দিকে ডিএমপির রমনা মডেল থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার প্রধান ফটক আটকানো। ভেতরে দুই-একজনকে সাধারণ পোশাকে দেখা গেলেও গেট দিয়ে কাউকে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি।
পুলিশের সমিতি-অ্যাসোসিয়েশন
স্থগিত, আইজিপির ১২ নির্দেশনা
এদিকে, পুলিশের সব খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গুলির হিসাব করা, বাহিনীর সদস্যদের সবরকম সমিতি-অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম স্থগিত করাসহ ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম।
সরকার পতনের পর নৈরাজ্যের মধ্যে সারাদেশে থানায় হামলা এবং বিপুলসংখ্যক পুলিশের হতাহতের ঘটনায় পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার প্রেক্ষাপটে বুধবার এই বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়েই এসব নির্দেশনা দেন নতুন আইজিপি।
১২ দফা নির্দেশনা : ১. রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিওএম, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), সব মেট্রোপলিটন এবং জেলা পুলিশ লাইন্সসহ অন্য সব পুলিশ ইউনিটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ফোর্সের শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২. ঢাকা মহানগর পুলিশের রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিওএম, এপিবিএন, সব মেট্রোপলিটন পুলিশ, জেলা পুলিশ, সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষায়িত সব পুলিশ ইউনিটের সব অফিসার এবং ফোর্সকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে।
৩. ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব মেট্রোপলিটন, জেলা, নৌ, রেলওয়ে এবং হাইওয়ে থানার অফিসার ও ফোর্সদের স্ব স্ব ইউনিটের পুলিশ লাইন্সে যোগ দিতে হবে।
৪. পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অপারেশন্স কন্ট্রোল রুম সক্রিয় করা, দায়িত্ব বণ্টন করা এবং সারাদেশের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৫. ফোর্সের মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের দাফন/সৎকার দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. পুলিশের সব অস্ত্র-গুলির হিসাব, খোয়া/হারানো অস্ত্র-গুলির হিসাব, সিসি (কমান্ড সার্টিফিকেট)সহ সব ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে হবে।
৮. সব অস্ত্রগারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় গার্ড অতিসত্ত্বর মোতায়েন করতে হবে। সিনিয়র অফিসাররা পুলিশ রেগুলেশন্স অনুযায়ী অস্ত্রাগারের নিরাপত্তা, অস্ত্র-গুলি ইসু্য ও জমা-সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার লেখার বিষয়ে বিদ্যমান বিধিবিধান পালন নিশ্চিত করবেন।
৯. মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপাররা নিজ নিজ এলাকার জ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেশাজীবী, ছাত্র প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি থানা এবং থানা এলাকার নিরাপত্তা বিধানে আপৎকালীন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
১০. থানার সব অফিসার ও ফোর্সের ব্যক্তিগত হেফাজতে থাকা অস্ত্র-গুলি স্ব স্ব পুলিশ লাইন্সে বা নিকটস্থ অস্ত্রগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
১১. বাংলাদেশ পুলিশের সব সমিতি এবং অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
১২ শৃঙ্খলার স্বার্থে সব স্তরের পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত, দলীয়, ব্যাচ, সমিতি, অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে পুলিশের কার্যক্রম-সংক্রান্ত কোনো প্রকার বিবৃতি, দাবি, মন্তব্য বা প্রতু্যত্তর করতে পারবে না।
এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে আদেশে জানানো হয়েছে।