আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে শেয়ারবাজারে সুবাতাস বইতে শুরু হয়েছে। দেড় দশক পর বিনিয়োগকারীরা ভিন্ন এক শেয়ারবাজার দেখছেন। প্রতিদিনই সূচকের বড় উত্থান দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে কালোটাকা আসছে। পাশাপাশি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তাই বিগত সরকারের আমলে যারা অবৈধ টাকা কামিয়েছেন তারা বিনিয়োগ করছেন। এদিকে বর্তমান কমিশনের নানা অনিয়ম থেকেও বাজার বের হয়ে আসবে এমন আশাও রয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের কয়েকজন ৫ আগস্টের পর আর অফিসে আসছেন না।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন কর্মদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক বেড়েছে ৬৯৫ পয়েন্ট। এর মধ্যে আগের দুই দিন মঙ্গলবার ও বুধবার ডিএসইর সূচক বেড়েছে যথাক্রমে ১৯৭ এবং ১৯৩ পয়েন্ট। অর্থাৎ দুই দিনে মোট ৩৯০ পয়েন্ট বেড়েছে।
আর বৃহস্পতিবার এক দিনেই বেড়েছে ৩০৬ পয়েন্ট। এদিন ডিএসইতে এক হাজার ৬০৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭৭৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে লেনদেন বেড়েছে ৮৩০ কোটি ৯১ লাখ বা ১০৭ শতাংশ।
দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের খবরে গত তিন দিনে ডিএসইর সূচক বেড়েছে ৬৯৩ পয়েন্ট। এটি বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। এর আগে এই রকম টানা তিন দিনের উত্থানে ডিএসই সূচকের এমন উত্থান হয়নি।
জানা গেছে, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থার কারণেই
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন আস্থার ভিত তৈরি হয়েছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিনিয়োগকারীরা ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত আড়াই বছরে লাগামহীন পতনে দেশের শেয়ারবাজার তলালিতে নেমে গিয়েছিল। দীর্ঘদিনের ঘুণে ধরা শেয়ারবাজার এখন বিশাল শক্তিমত্তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তারা আশা করছেন, ড. ইউনূসের ছোঁয়ায় দেশের শেয়ারবাজার নতুন উচ্চতার দিকে অগ্রসর হবে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৭ হাজার ১০৫ পয়েন্ট। এরপর থেকেই চলেছে থেমে থেমে পতনের ছোবল। পতনের ছোবলে ২ বছর ৭ মাসে ডিএসইর সূচক কমেছে প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট। অথচ এর মধ্যে শেয়ারবাজারে নতুন আইপিও শেয়ার এসেছে ২০টির বেশি। যেগুলোর মূলধন সূচকে যোগ হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সময়ে বাজারে তারল্য সংকটের কারণে যতটা কমেছে তারচেয়ে বেশি কমেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত ইসলামের সহযোগিতায় আওয়ামীপন্থিদের লুটপাটে শেয়ারবাজারের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা শিবলী রুবাইয়াত ও তার আওয়ামীপন্থি দোসরদের দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত দাবি করেছেন।
এদিকে চলতি সপ্তাহে এক দিনও অফিস করেননি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। সদ্য ক্ষমতা থেকে বিতারিত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন শিবলী রুবাইয়াত জনরোষের ভয়ে অফিস করছেন না বলে জানা গেছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামও ভয়ে আছেন। তার মেয়াদে পুঁজিবাজারে ব্যাপক লুটতরাজ হয়েছে। তার যোগসাজশে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। বিভিন্ন পর্ষদ পুনর্গঠনের নামে বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পরিচালক হিসেবে বসিয়ে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া; ব্যবসা না করতে পেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিকে নিজের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে সেগুলোকে পুনরায় বাজারে নিয়ে এসে বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেন তিনি। তার বিরুদ্ধে টাকা পাচার এবং পাচারকারীদের সহায়তা করারও অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে কমিশনের পুনর্গঠন চেয়েছেন খোদ সংস্থাটির কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার বিএসইসি অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান।
সভায় বিএসইসির কর্মকর্তারা শেয়ারবাজারের অধ্যাদেশ, আইন ও বিধিবিধানের বাইরে কোনো সুপারিশ বা কোনো ধরনের কাজ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া বুধবারও বিএসইসির কর্মকর্তারা এসব বিষয় নিয়ে বেশ সরব ছিলেন। এই সময় তাদের পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি উত্থাপন করা হয়।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কমিশনের অভিজ্ঞ সিনিয়র কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে নিয়োগ দিতে হবে।
শেয়ারবাজারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। শেয়ারবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে আইনের ১৭ ধারা মোতাবেক কর্মকর্তাদের কাছে ক্ষমতা অর্পণ (ডেলিগেশন অব পাওয়ার) করতে হবে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্রম্নত পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিকিৎসা সুবিধা পুনর্বহাল করতে হবে।
বিএসইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের কারণে তারা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে ভূমিকা না রেখে স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকেন। তাছাড়া তাদের শেয়ারবাজার সম্পর্কে কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে বাজারের উন্নয়নে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন না।
সভায় অভিযোগ করা হয়, এক সময় কমিশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তথা নির্বাহী পরিচালকদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কমিশন অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কমিশন এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অথচ এসব সিদ্ধান্তের দায় তাদের ওপরও এসে পড়ছে।
বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সাইন্স বিভাগে শিক্ষক আল আমিন যায়যায়দিনকে বলেন, বাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিন বাজারে চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ একটি গ্রম্নপ বাজারে সক্রিয় ছিল। অন্যদের কোনো ব্যবসা করতে দেওয়া হয়নি। যারা এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিল তারাও বাজারে আসছে। অপ্রদর্শিত হউক বা প্রদর্শিত হউক বাজারে অর্থ আসছে। বৃহস্পতিবারের লেনদেন এটাই প্রমাণ করে। আশা করা যায় শেয়ারবাজার একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে যাবে।