দেশের কোথাও পুলিশের কোনো কার্যক্রম নেই। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিরাপত্তাহীনতাসহ চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করছে মানুষ। এমনকি পুলিশ না থাকার কারণে দেশে বড় ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে পুলিশ দায়িত্ব না পালন করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল মামুন বাহিনীটির সদস্যদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি পুলিশ সদস্যদের জানমাল ও স্থাপনা রক্ষায় সেনাবাহিনী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কাছে সহায়তা চেয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ইসু্যতে নিজেদের কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে।
সরেজমিন ঢাকায় পুলিশের বিভিন্ন অফিসে গিয়ে গেছে, গেটে তালা দেওয়া। গেট পাহারা দেওয়ার জন্যও পুলিশ সদস্যরা নেই। এমনকি পুলিশের সঙ্গে থাকা আনসার সদস্যদেরও কোথাও দেখা যায়নি। শুধু সরকারি ও আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে স্বল্প পরিমাণে আনসার দেখা গেছে। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করে দায়িত্ব পালন করছেন।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেওয়ার পর থেকেই ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে ৩ শতাধিক ছাত্র-জনতা নিহত হন। এরপর থেকেই বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ সদস্যদের ওপর চড়াও হতে থাকেন। নির্মমভাবে পিটিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে জনতা। একই সঙ্গে থানাসহ দেশের ৪৫০টি পুলিশের স্থাপনা ভাঙচুরের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দেশের অধিকাংশ থানা থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে যান পুলিশ সদস্যরা। অনেক পুলিশ সদস্য আটকা পড়েন। পরে তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে জীবন রক্ষা করেন। ঢাকার অধিকাংশ থানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাড্ডা থানার পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে রাজারবাগ নিয়ে যাওয়া হয়। দেশের অধিকাংশ থানায়ই এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি থানা থেকে পুলিশের অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়ে গেছে। এ ছাড়া পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে থানায় থাকা মামলার নথিসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগতে পারে। শুধু যেসব মামলার কপি আদালতে পাঠানো হয়েছে, সেসব মামলার নথিপত্র পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া থানা থেকে মামলা বা আলামত সংক্রান্ত কোনো
তথ্য পাওয়া নাও হতে পারে।
এদিকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের প্যাডে বাংলাদেশ পুলিশের অধ্বস্তন অফিসারদের তরফ থেকে দেশবাসীর উদ্দেশে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেশ থেকে স্বৈরাচার উৎখাতের জন্য সব সৈনিকদের অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়, 'আমরা নিহত ছাত্রদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। আহতদের সুস্থতা কামনা করছি। আমরাও চাকরিজীবনে বৈষম্যের শিকার। দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলা হয়, আন্দোলনে সারাদেশে শত শত পুলিশ শাহাদতবরণ করেছেন। পুলিশ সদস্যদের হত্যার সঙ্গে ছাত্ররা জড়িত নয়। দুষ্কৃতিকারীরা জড়িত। পরিস্থিতির কারণে দেশবাসী পুলিশকে শত্রম্ন মনে করছে। প্রকৃতপক্ষে পুলিশ জনগণের সেবক। রাষ্ট্র যে আইন তৈরি করেছে, তা পুলিশ মানতে বাধ্য। আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে মানুষের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। সার্জেন্ট অথবা সাব ইন্সপেক্টরসহ নিম্নপদে নিয়োগের পর থেকেই সিনিয়র অফিসারদের অথবা রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ হাসিলের বাহক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হই। সেটা বৈধ বা অবৈধ যাই হউক না কেন, যে কোনো আদেশই পালন করতে হয়'।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উলেস্নখ করা হয়, 'আমাদের কর্মকর্তাদের অধিকাংশই দলীয় পরিচয়ে দুষ্ট। কোটা সংস্কার আন্দোলন বা অন্য কোনো আন্দোলনে সরাসরি গুলি করতে না চাইলেও সেটা করতে হয় দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। এভাবেই আমাদের দেশবাসীর কাছে ভিলেনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আমরা কোটা সংস্কারের মতো পুলিশ বাহিনীতেও সংস্কার চাই। আমরা দেশবাসীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই। কোনোভাবেই বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কে জড়াতে চাই না। পুলিশ বাহিনী হিসেবে নিরীহ ছাত্রদের সঙ্গে যে অন্যায় করেছে, তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। প্রতিটি পুলিশ সদস্যই কারও না কারও ভাই, বোন, বন্ধু-বান্ধব, মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজন। আমরাও আপনাদেরই সমাজের অংশ। অতীতের যে কোনো সময়ের মতো আমাদের আপনারা পাশে পাবেন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ'।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, 'আমাদের কোনো সদস্য অন্যায় করে থাকলে তার অবশ্যই বিচার হবে। দেশের এই সুসময়ে আমরা আপনাদের কাছে থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের সব স্থাপনার নিরাপত্তা চাই। পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা চাই। গত সোমবার সারাদেশে ৪৫০টির বেশি থানা আক্রান্ত হয়েছে। এগুলো আপনাদেরই সম্পদ, দেশের সম্পদ। প্রতিটি পুলিশ সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কর্মবিরতি ঘোষণা করছি। আমরা বৈষম্যহীন পুলিশ বাহিনী চাই। পুলিশ বাহিনীর সংস্কার চাই। দেশের সবাই এ সময় একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।'
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পুলিশ একটি সরকারি বাহিনী। এ বাহিনী পরিচালনার জন্য আইন আছে। আইন মোতাবেক পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হয়। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ বাহিনী সেই সরকারের আদেশ মতোই কাজ করে।
এদিকে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল মামুন এক ভিডিও বার্তায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। একই সঙ্গে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। আহত পুলিশ সদস্যদের দ্রম্নত আরোগ্য কামনা করেন। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
পুলিশপ্রধান বলেন, সব পুলিশ সদস্যের জানমাল ও পুলিশ স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টরা ও দেশবাসী সহায়তা করছে। ভবিষ্যতে এমন সহায়তা আরও বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে তিনি পুলিশের তরফ থেকে উত্থাপিত দাবি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানে বাংলাদেশ পুলিশ আন্তরিক বলে জানান।