এনটিভির খবরে নিহতের সংখ্যা শতাধিক
সারাদেশে প্রতিহিংসার আগুন হামলা-ভাঙচুর, নিহত ৫৬
প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০৫
যাযাদি রিপোর্ট
পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থাপনা ও বাসভবনে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। শত শত বিক্ষুব্ধ জনতা বেসরকারি টেলিভিশন ভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবন, ক্ষমতাসীন দলীয় মন্ত্রী-এমপি ও নেতাকর্মীর বাসা-বাড়ি, দলীয় কার্যালয়, থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাদের ব্যবহৃত বিপুলসংখ্যক যানবাহনেও। এতে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া সারাদেশে প্রতিহিংসার আগুন ও ভাঙচুরে ৫৬ জন নিহত হয়েছেন। রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যান্ত এনটিভিতে বলা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা শতাধিক।
সোমবার বিকালে গুলশানের বারিধারার কূটনৈতিক পাড়ায় অবস্থিত বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের কার্যালয় ও হাতিরঝিলে অবস্থিত মাই টিভির কার্যালয় ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ছাড়া বেসরকারি ডিবিসি নিউজ, এটিএন বাংলা ও সময় টেলিভিশন কার্যালয় ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার বিকাল ৫টার দিকে শত শত বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধান বিচারপতির ঢাকার ১৯ নম্বর হেয়ার রোডের বাসভবনে ঢুকে পড়ে। জনতা দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেওয়ার সাহস করেননি। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপদ জায়গায় সরে যান। পরে বাসভবনে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। ভাঙচুরের সময় বিক্ষুব্ধ জনতা বাসভবন থেকে যে যা পেয়েছেন, তাই নিয়ে গেছেন।
সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শত শত ছাত্র-জনতা ধানমন্ডিতে অবস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসার গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা আগেই নিরাপদ জায়গায় চলে যান। বাসার ভেতর ঢুকে যে যার যার মতো করে জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এরপর বাসায় ভাঙচুর করে। বাড়ির ভেতর আগুন দেওয়া হয়েছিল। পরে তা নিভে যায়। যদিও হামলার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবার নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করেন।
এদিকে ঢাকার প্রতিটি পাড়া-মহলস্নায় থাকা আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনের সব অফিস ভাঙচুর করে এতে আগুন দিয়েছে ছাত্র-জনতা। সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মগবাজার মোড়ে থাকা পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে এতে আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। একই সঙ্গে সেখান দিয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেটকার আটকিয়ে প্রথমে তা ভাঙচুর করে। পরে এতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। গাড়ির চারদিকে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতাকে উলস্নাস করতে দেখা গেছে।
একই সময় আইডিবি ভবনে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। এ ছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের দুটি অফিস ভাঙচুরের পর এতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে উলস্নাস করে ছাত্র-জনতা। অন্যদিকে মহাখালী, তেজগাঁও সাত রাস্তা মোড় পুরো ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সব দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের পর এতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকার রাস্তায় থাকা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিভিন্ন মূর্তি, নাম ফলক ভেঙে ফেলে। ছিঁড়ে ফেলে পোস্টার। রাজধানীর উত্তরার হাউজ বিল্ডিং মোড়ে টায়ারে আগুন দিয়ে অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় জমায়েত হওয়া মানুষজনকে লক্ষ্য করে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। বিক্ষুব্ধ জনগণ চারপাশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভিন্ন ফেস্টুন ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
একইসঙ্গে 'পলাইছেরে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে', 'ভুয়া ভুয়া, আওয়ামী লীগ ভুয়া', 'হৈ হৈ রৈ রৈ, আওয়ামী লীগ গেলি কই' সহ বিভিন্ন ধরনের স্স্নোগান দিতেও শোনা গেছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের বাসাবাড়ি, দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
এদিকে সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানা ঘিরে ফেলে কয়েকশ মানুষ। থানার নিচে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিক্ষোভকারীদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক মানুষ আহত হন।
রাত সাড়ে ৮টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, উত্তরা পূর্ব, বাড্ডা, রামপুরা, খিলগাঁও থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। জীবন বাঁচাতে পুলিশ সদস্যরা থানা থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে গেছেন। বিকাল ৪টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। এর আগে থানাটিতে হামলা ও ভাঙচুর করেছে বিক্ষোভকারীরা।
বিকাল ৫টার দিকে মোহাম্মদপুর থানায় হামলা করে বিক্ষোভকারীরা। সন্ধ্যা ৬টার দিকে থানায় আগুন দেওয়া হয়। একই অবস্থা খিলগাঁও থানাতেও। রোববার রাতেই থানা থেকে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। হামলা হওয়ার আশঙ্কায় তাদের অস্ত্র ও জরুরি দলিল নিরাপদ হেফাজতে রেখে নিরাপদে সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ঢাকার অধিকাংশ থানা ফাঁকা পড়ে আছে। যদিও এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সোমবার রাত ৮টার দিকে রাজধানী ঢাকার গুলিস্তানে পুলিশ সদর দপ্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় দুটি ভবনে আগুন দেওয়া হয়। দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা জীবন বাঁচাতে দেয়াল টপকে পালান। এ সময় পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়ে যোগাযোগ করেন। এ ঘটনার সময় পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি আব্দুলস্নাহ আল-মামুন উপস্থিত ছিলেন না বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে সোমবার বিকাল ৫টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। এ ছাড়া একই সময় বিমানবন্দরের ভেতর আওয়ামী লীগের এক নেতার গাড়ি ভাঙচুর করে। বিমানবন্দরের ঢুকতে টার্মিনাল ১ ও ২ এর মধ্যবর্তী স্থানে ভাস্কর্যটি পড়ে আছে। এর ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করছেন লোকজন। এর সামনেই একটি ব্যক্তিগত গাড়ি উল্টে পড়ে আছে। গাড়ি থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে নিয়েছে লোকজন। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পরই হাজারও মানুষ বিমানবন্দরের সামনে জড়ো হন।
সোমবার রাতে ঢাকার ধানমন্ডিতে ভারতের 'ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার' এ আগুন দেওয়া হয়। এতে সেখানকার সব জিনিসপত্র পুড়ে যায়। সেখান থেকে অনেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র ভ্যানে তুলে নিয়ে গেছে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া : জেলার কসবার পানিয়ারূপ গ্রামে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গ্রামের বাড়ি, কসবা থানা, পুলিশের কসবা সার্কেলের এএসপির অফিস, উপজেলা পরিষদের নবনির্মিত ডাকবাংলো, আখাউড়া উপজেলা পরিষদ ও আখাউড়া পৌরসভার মেয়র তাকজিল খলিফা কাজলের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ঢাকার সাভারে হামলা : সোমবার বিকাল ৩টার দিকে সাভার পৌর এলাকার থানা রোড়ে স্স্নোগান দিতে দিতে কয়েকশ বিক্ষুব্ধ জনতা প্রবেশ করে। এ সময় সাভার প্রেস ক্লাবে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরে তারা সাভার মডেল থানার দিকে এগিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা সাভার মডেল থানার সামনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
চট্টগ্রাম : সোমবার বিকাল ৩টার দিকে চট্টগ্রামের মাঠে নামে সর্বস্তরের জনতা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী থেকে পুরুষ সবাই সড়কে নেমে স্স্নোগান দিয়েছেন। সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে মাঠে নামেন জনতা। বিক্ষুব্ধ জনতা মহানগরীর কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, পাহাড়তলী ও চান্দগাঁও থানায় হামলা চালায়। থানা থেকে পুলিশের অস্ত্র, গুলি ও মালামাল লুট হয়। একই সঙ্গে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হন।
সুযোগ বুঝে একটি স্বার্থান্বেষী চক্র ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি গবাদিপশুর খামারেও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
চট্টগ্রাম চাঁদগাঁও ব্যাপারী পাড়া এলাকার এসএস ডেইরি ফার্মের মালিক সনজীব নাথ বলেন, 'গতকাল হঠাৎ করেই আমার ডেইরি ফার্মে কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা করে। ফার্মে শুধু কাজের ছেলেই একা কাজ করছিল। সে সময় আমি ফার্মে না থাকায় কাজের ছেলেকে কুপিয়ে জখম করেছে। ফার্মে স্থাপনকৃত সড়কের অংশের বেশ কয়েকটি সিসি টিভি ভেঙে ফেলে। দুষ্কৃৃতকারিরা একটি গাড়িতেও আগুন দেয়। পরে খামারে বেশকিছু মালামাল লুটপাট করে চলে যায়।'
অন্যদিকে সরকার পতনের পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ছাড়া যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা হেলাল আকবর বাবর চৌধুরীর নন্দন কাননের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে।
আমাদের গাজীপুর মহানগর প্রতিনিধি জানান, দুপুরে আন্দোলনকারীরা চান্দনা চৌরাস্তা এলাকা দখল করে বিক্ষোভ করেন। তারা টঙ্গী থেকে হোতাপাড়া পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান। আন্দোলনকারীদের ধাওয়ার মুখে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। বিকাল ৩টার দিকে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। এর কিছুক্ষণ পর আন্দোলনকারীরা আবার একত্রিত হয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সংলগ্ন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এসে ধাওয়া দেয় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা পার্শ্ববর্তী রথখলাস্থ গাজীপুর প্রেস ক্লাবে হামলা করে সিসি ক্যামেরা ও ইটপাটকেলে ক্লাবের জানালার কাঁচ ভাঙচুর করেন। বিকালে আন্দোলনকারীরা হোতাপাড়ায় অবস্থিত বিজিবি ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে গেট এবং জয়দেবপুর থানায় হামলা করেন। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শিববাড়ি এলাকায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন।
আমাদের ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপনের বাড়ি, আওয়ামী লীগ অফিস, নাজমুল হাসান পৌরপার্কে আগুনসহ দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর করে এতে আগুন ধরিয়ে দেন। বিক্ষুব্ধ জনতা উপজেলাটির আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাখাওয়াত মোলস্না, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সেন্টু, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিক আহমেদ সৌরভ, আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা সুলাইমানসহ একাধিক নেতার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি, র্মুযাল ভাঙচুর ও অ্িগ্নসংযোগ করে।
কুমিলস্না থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান : কুমিলস্না-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে উত্তেজিত জনতা। সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কুমিলস্না নগরীর মনোহরপুর মুন্সেফবাড়ি এলাকায় সংসদ সদস্য বাহারের বাড়িতে এই হামলা চালানো হয়। এ সময় উত্তেজিত কয়েকশ জনতা বাহারের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ভাঙচুর করে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়াও কুমিলস্না মহানগর আওয়ামী লীগ অফিসের ৮তলা ভবনটিতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তান্ডব চালানো হয় সেখানেও। এ ছাড়া পুলিশ লাইন্স, মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ বেশ কিছু স্থাপনায় আগুন দেন বিক্ষুব্ধরা। নগরীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ও উপজেলাতেও ভাঙচুর ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও জেলার কান্দিরপাড় এলাকার বিভিন্ন স্থাপনা, পুলিশ বক্স ভাঙচুর, নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরদের কার্যালয় ও বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিলস্না সদর দক্ষিণ পদুয়ার বাজার ওভারব্রিজ, দেবিদ্বার উপজেলা সদর, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
যশোর থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় হোটেলের ভেতর অনেকে আটকা পড়েন। হেলিকপ্টারে করে উদ্ধারকারী দল ১৬ তলাবিশিষ্ট হোটেলের ছাদ থেকে একজনকে উদ্ধার করেন। আরও কয়েকজনকে ১৪ তলার বারান্দা থেকে উদ্ধার করেন। পরে জনতা শাহীন চাকলাদারের কাঁঠালতলা এলাকার বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করেন। শহরের চারখাম্বা মোড়ে অবস্থিত শেখ রাসেলের ভাস্কর্যও ভাঙচুর করা হয়েছে।
মাদারীপুর থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, বিকালে বিভিন্ন এলাকার সমর্থকরা আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়ে মাদারীপুর শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকায় এসে জড়ো হয়ে বিভিন্ন সেস্নাগান দিতে থাকেন এবং একপর্যায় শহরের শাজাহান খানের বাসা, বাহাউদ্দিন নাছিমের বাসভবন, সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, সার্বিক ফুড ভিলেজ, শাজাহান খান সমর্থিত আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং সার্বিক গাড়ির কাউন্টারসহ কয়েকটি স্থাপনায় আগুন দেন জনতা। এ সময় জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি ফারজানা নাজনীনের বাসভবন ও কিশোর গ্যাং নেতা নোবেল বেপারীর মালিকানাধীন মোটর সাইকেল শোরুম ও বাড়ি পোড়ানো হয়। পুরাতন কোর্ট মোড়ে নবনির্মিত মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরটিও ভাঙচুর করে এতে আগুন দেওয়া দেয়। অনেক বিক্ষোভকারীকে সিলিং ফ্যান, কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল লুট করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
আমাদের নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল ও নাটোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীর বাসভবনে আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শহরের কান্দিভিটুয়া এলাকায় এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পাটোয়ারী ক্লিনিকে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। অন্যদিকে শহরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেন সাধারণ মানুষ। এদিকে বনপাড়া বাইপাস মোড়ে বঙ্গবন্ধু মু্যরালে হাতুরি পেটায় তার প্রতিকৃতি ভাঙচুর করা হয়। শহরের কান্দিভিটুয়া এলাকায় নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের ডুপেস্নক্স বাড়িতে আগুন দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় বাড়ির ভেতরে থাকা গাড়িসহ সব আসবাপত্র জ্বলতে দেখা যায়। এ সময় হাজার হাজার উৎসুক জনতা জান্নাতি প্যালেসের সামনে ভিড় করেন।
অপরদিকে বনপাড়ায় ডা. পাটোয়ারীর বাসায় হামলা চালিয়ে সামনের অংশে অগুন দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় বাড়ির সামনে থাকা তিনটি মোটর সাইকেল ও বাইপাসে ৪টি বাস পুড়িয়ে দেন জনতা। সন্ধ্যায় সেনা পাহারায় এসিল্যান্ডেরে গাড়িতে বাসা ছাড়েন তিনি।
বগুড়া : সোমবার শহরের সাত মাথায় নামে লাখো মানুষের ঢল। আনন্দ মিছিল নিয়ে তারা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পোস্ট অফিস, সদর থানা পুলিশ ফাঁড়ি, উপজেলা পরিষদ ও পুলিশ পস্নাজা ভাঙচুর করেন। ভাঙচুরের সময় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এরপর এসব স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হন অর্ধশতাধিক।
নারায়ণগঞ্জ : সোমবার বিকালে শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন চাষাঢ়ায় জড়ো হতে থাকেন। পরে সবাই মিলে উলস্নাস করেন। আনন্দ মিছিল চলাকালে দুর্বৃত্তরা নারায়ণগঞ্জ শহরের বায়তুল আমান, রাইফেল ক্লাব, এ্যাটেল মাটি, শামীম ওসমানের বাড়ি, শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরি ওসমানের বাড়ি-গাড়ি, চাষাঢ়ায় সেলিম ওসমানের বাড়ি, আজমেরি ওসমান মার্কেট (আলম কেবিন সংলগ্ন) নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, শহরের দুই নম্বর রেলগেট এলাকার আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় লুটপাটও করা হয়।
ঝালকাঠি : সোমবার বিকাল ৩টার দিকে রোনালসে রোডে ১৪ দলের সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর বাসভবন, ঝালকাঠি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কলেজ রোডের বাসভবন, পৌর কাউন্সিলর কামাল শরীফ ও হাফিজ আল মাহমুদ, ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম মাসুমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এদিকে সকাল থেকে ছাত্র-জনতা শহরের রাস্তায় নেমে আসার আগেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা।
রাজশাহী : বিক্ষুব্ধ জনতা রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) ভবন, রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) হেডকোয়ার্টার, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রের বাসভবন, নগরীর মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, আরএমপির হেডকোয়ার্টারের নিচে থাকা প্রায় ছয়টি গাড়ি, রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বাসভবন, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর শপিংমল ওমর থিম পস্নাজা, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টুর রেস্টুরেন্টে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীজুড়ে সাঁটানো থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পোস্টার ছিঁড়ে আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের পর ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের মহানগর কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর তা বুলড্রোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ : সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের বাসভবন ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার বিকালে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা এই হামলা চালান। এ ছাড়া বিক্ষুব্ধরা নগরের পন্ডিতপাড়া এলাকায় ময়মনসিংহে সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদের বাসায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পর চেয়ার, টেবিল, সোফা বের করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া নগরের শিববাড়ি রোডে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, আঠারবাড়ি বিল্ডিং এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের বাসায় অগ্নিসংযোগ, সার্কিট হাউস সংলগ্ন বঙ্গবন্ধুর মু্যরাল ভাঙচুর, রাইফেলস ক্লাব ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নওশেল আহমেদ অনির নাহা রোডের বাসায় আগুন, সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র আসিফ হোসেন ডনের বাসায় আগুন দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহের কালিবাড়ি কবরখানা এলাকায় সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটুর বাসায় ভাঙচুর চালানো হয়। ময়মনসিংহ সদর আসনের সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানের নাটকঘর লেনের বাসায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন বলেন, থানাতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ-৭ ত্রিশাল আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাফেজ রুহুল আমিন মাদানির বাসা ও ত্রিশাল অটোরিকশা স্ট্যান্ড সংলগ্ন পেট্রোল পাম্পে ভাঙচুর চালানো হয়।
এদিকে মুক্তাগাছায় পৌর মেয়র বিলস্নাল হোসেন সরকারের ভাবকির মোড় এলাকায় পেট্রোল পাম্পে আগুন, বাসায় আগুন, উপজেলা যুবলীগ সভাপতি মাহবুবুল আলম মনির বাসায় অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মী ও সংসদ সদস্যদের বাসভবনে হামলার খবর পাওয়া গেছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নগরজুড়ে উলস্নাসের সঙ্গে চলছিল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
আমাদের নড়াইল প্রতিনিধি জানান, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই বিক্ষুব্ধ জনতা সোমবার বিকালে নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার নড়াইলের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে মাশরাফির ছোট ভাই মোরসালিন মুর্তজা বলেন, কথা বলার অবস্থা আমার নেই। কিছুই ভালো নেই। মাশরাফি ছাড়াও নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস, সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু, জেলা আওয়ামী কার্যালয়েও আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের শহরের কেশব মোড় এলাকায় অবস্থিত রাজনৈতিক অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ শহরে সোমবার বিকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের খরমপট্টি বাসভবনে শত শত মানুষ হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। উত্তেজিত জনতা বাসার কিছু মালামাল বাইরে এনে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া বাসার বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যায়। এ ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসা ভাঙচুর করা হয়। বাসাটি থেকে বিভিন্ন ধরনের মালামালও লুট হয়। এ ছাড়া ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার বিপস্নব কুমার সরকারের খরমপট্টি এলাকার বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। হামলা হয়েছে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোলস্না সুমনের বাসভবন ও ব্যক্তিগত চেম্বারে। শহরের কালীবাড়ি মার্কেটে অবস্থিত সময় টেলিভিশন ও প্রতিদিনের বাংলাদেশ অফিস, প্রেস ক্লাবে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হামলা হয়েছে।
বরিশাল : মহানগর আওয়ামী লীগের সা?ধারণ সম্পাদক ও ব?রিশাল সি?টি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সের?নিয়াবাত সা?দিক আব্দুলস্নাহর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার সন্ধ্যায় নগরীর কালীবাড়ি রোডস্থ বাসভবনে এ ঘটনা ঘটে। বরিশাল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ফায়ার ফাইটার মো. ফারুক হোসেন জানান, আগুন নির্বাপন করার পর সেখান থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।