প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তার দেশ ত্যাগের পর গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলে নেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। তারা ভুয়া ভুয়া সেস্নাগান দিয়ে গণভবনে ঢুকে সেখানে ব্যাপক লুটপাট চালায়। এখান থেকে মাছ-হাঁস, আসবাব, লেপ, কাঁথা, বালিশ ও চেয়ার থেকে শুরু করে যে যা পেরেছেন নিয়ে বের হয়ে এসেছেন। বিকাল ৪টার দিকে উত্তেজিত জনতা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও সভাপতির কার্যালয়ের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরেও হামলা চালিয়ে আগুন দেয়। একই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও দখলে নেন ছাত্র-জনতা। ভাঙচুর চালানো হয় বিজয় সরণিতে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্যতেও। এসব কিছু মনে করিয়ে দেয় গণআন্দোলনের মুখে শ্রীলংকার মাহিন্দা রাজাপাকসের ক্ষমতা ছাড়ার সেই স্মৃতি।
সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছাড়ার পর ফাঁকা হয়ে যায় গণভবন। এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সোমবার বিকাল ৩টার পরে গণভবনে প্রবেশ করেন শত শত মানুষ। বিপস্নবের স্মারক হিসেবে গণভবন থেকে নামিদামি জিনিসপত্র, টেলিভিশন, ফুলের টব, বালতি, মাছ, মাংস নিয়েও বের হতেও দেখা গেছে। গণভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালা হাঁস, মুরগিও নিয়ে যান আন্দোলনকারীরা। এ সময় গণভবনে প্রবেশ করে সেলফিতে ছবি তুলতে দেখা গেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগের দ্বিতীয় দিন ঢাকামুখী জনস্রোতের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন দখল করেন জনতা। 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে গণভবনে প্রবেশ করেন। গণভবনের পর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ও জনতার দখলে চলে যায়। এরপর আন্দোলনকারীসহ সাধারণ জনগণ ঢুকে পড়েন সংসদ ভবনেও।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গণভবনের সভাকক্ষে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে উদ্যম নৃত্যে মেতে উঠেন বিক্ষোভকারী জনতা। অন্যদিকে ঘড়ি, রাউটার, কাগজ, কম্পিউটার, চেয়ার, সোফা, এসি, ফ্রিজ, প্রেন্টিং থেকে শুরু করে সবকিছু নিতে
\হবিক্ষোভকারীদের অনেকে বের হয়েছেন। শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ গণভবনের দেওয়ালে বিভিন্ন সেস্নাগান লিখেন। দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় চলা আন্দোলনের সফলতার স্মারক হিসেবে গণভবনের ফ্যান, টেবিল ও কম্বল নিয়ে যান বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বলেন, এ সম্পদ আমাদের। আমরাই নিয়ে যাচ্ছি। আজ আপামর জনসাধারণের বিজয় দিবস। এ সময় শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে কেউ কেউ সেস্নাগান দেন।
গণভবনের সবুজ মাঠে তাদের উলস্নাসে খেলাধুলা করতে দেখা যায়। এ সময় অনেককে কোলবালিশ, হাঁড়িপাতিল ও বালতি ভরে গণভবনের বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়। কারো হাতে চেয়ার, কারো হাতে বড় মাছ বা কারো হাতে কবুতরও দেখা গেছে। যে যেভাবে যা পেয়েছে তাই নিয়ে গেছেন। সেখানে হাজারো ছাত্র-জনতা বিজয়োলস্নাস করে 'ভুয়া', 'ভুয়া' ও 'পালাইছে', 'পালাইছে'সহ বিভিন্ন ধরনের সেস্নাগান দিতে থাকে। এর আগেই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর আসে। এই খবরে আন্দোলনকারীদের উলস্নাসে ফেটে পড়তে দেখা গেছে। এ ছাড়াও গণভবনের বিভিন্ন স্থাপনার পাশে তরুণদের সেলফি তুলতে দেখা গেছে। কেউ আবার গণভবনে বেডরুমে প্রবেশ করে বিছানায় শুয়ে ছবি তুলেছেন।
দেখা গেছে, গণভবনের লনে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীদের ঘুরে বেড়াতে। সুইমিং পুলে নেমে অনেকেই উলস্নাস প্রকাশ করেন। ভেতরে থাকা কাঠের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। শেখ হাসিনার অফিস রুম তছনছ করা হয়। বিক্ষোভকারীরা রিকশা নিয়ে ঢুকে পড়েন গণভবনে।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় গত দেড় দশক গণভবনেই ছিলেন। ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে সোমবার ২টার পর প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও জনতার দখলে
গণভবন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও দখল করে নেন। সেখানে তাদের উলস্নাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। পাশাপাশি শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে সেস্নাগান দেন কেউ কেউ। দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সারাদেশে উলস্নাস শুরু হয়। ঢাকার রাস্তা দখলে নিয়ে আনন্দ উলস্নাস করে লাখো জনতা।
ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও
আ'লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন
সোমবার বিকাল ৪টার দিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও সভাপতির কার্যালয়ের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরেও হামলা চালিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে থেকেই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই বাড়িতেই সপরিবারে হত্যা করা হয়। পরে বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।
বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও ভাঙচুর করে আরেক দল মানুষ। বিকালে একই সময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও হামলা হয়। সেখানে দলের সভাপতির অফিসও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কাছাকাছি সময়ে ধানমন্ডি ৩/এ-তে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়েও হামলা করা হয়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এক কর্মচারী বলেন, 'এখানে কিছু লোকজন প্রবেশ করে প্রথমে ভাঙচুর ও পরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।'
আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, 'আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন। আর আশপাশের সংগঠনগুলোর অফিস সাইনবোর্ড ভাঙচুর করা হয়েছে।'
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নতুন ভবনটি সহযোগী সংগঠনেরও কার্যালয় হিসেবেও ব্যবহার হয়।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উল্টো পাশে ১৯ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়। ২৫ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যুবলীগ কার্যালয়। আওয়ামী লীগের আরও কয়েকটি সংগঠনের কার্যালয় সেখানে আছে। যেগুলোতেও ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা।
এরপর ধানমন্ডি ৩/এ-তে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা হয় বলে জানিয়েছেন সেই কার্যালয়ের একজন রাজনৈতিক কর্মকর্তা।
বিকাল ৪টার দিকে আগুন দেওয়া হয় তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়েও। এই আগুন পাশের গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে।