দেশ ছেড়ে পালালেন হাসিনা-রেহানা

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা
সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তুমুল গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৩৬ দিন আগে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সংঘাত আর তিন শতাধিক মানুষের মৃতু্যর মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। বিবিসি লিখেছে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়েছেন। তিনি প্রথমে ত্রিপুরার আগরতলায় গেছেন। তার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও রয়েছেন। সেখান থেকে সন্ধ্যায় দিলিস্ন লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্ডন এয়ারবেসে নেমেছে শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বিমান। সেখান থেকে দিলিস্ন গেছেন। পরে এনডিটিভি লিখেছে, তিনি শিগগিরই লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে সর্বাত্মক অসহযোগের মধ্যে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনও দখল করে নিয়েছেন। সেখানে পতাকা হাতে তাদের উন্মুত্ত উলস্নাসের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, প্রতিটি হত্যা, অবিচারের বিচার হবে। সবার চেষ্টায় দেশে শান্তি ফিরে আসবে। যেভাবে পতন ঘটল শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটি হাইকোর্ট বাতিল করার প্রতিক্রিয়ায়। ১ জুলাই মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের টানা কর্মসূচির মধ্যে সরকারও হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে, ফলে সেই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৪ জুলাই। সেদিন চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নে বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?' পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেমে থেমে মিছিল হ বের হয় 'তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার'। কিছুক্ষণ পর এই স্স্নোগান চলার পর অবশ্য স্স্নোগান পাল্টে বলা হয়, 'তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।' সেই রাতেই ছাত্রলীগ মিছিল বের করে, 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।' তবে পরদিন সকালে ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্যের জবাব দেবে ছাত্রলীগ।' সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। সেদিন সংঘর্ষে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে ছাত্রদল নেতাসহ তিনজন, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ছাত্রলীগকর্মী ও এক হকার এবং রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে এক শিক্ষার্থীর মৃতু্যতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। ১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার বিশ্বাস, শিক্ষার্থীরা আদালতে ন্যায়বিচার পাবে। তবে পরের দিন কমপিস্নট শাটডাউন কর্মসূচির ডাক আসে শিক্ষার্থীদের তরফে। সেদিন ঢাকার বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃতু্যর পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। দুপুরের পর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হতে থাকে। পরের তিন দিন ধরে চলে সংঘর্ষ, প্রাণহানি ঘটে দুই শতাধিক মানুষের। পরে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কখনো ৮ দফা, কখনো ৯ দফা দাবি জানানো হয়। ঘটনার পরম্পরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের 'এক দফা' দাবি জানানো হয়। পরদিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে সারাদেশে পুলিশসহ শখানেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ওইদিন সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে সোমবার 'লং মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সোমবার বেলা ১১টার পর থেকে লাখো জনতা ঢাকার শাহবাগসহ বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে শুরু করে। এরই মধ্যে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। ফের নির্বাসিত জীবন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কিন্তু দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার কর্মসূত্রে জার্মানিতে ছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা গিয়েছিলেন বোনের কাছে বেড়াতে। দেশে স্বজনদের হারিয়ে এরপর নির্বাসিত জীবন শুরু হয় শেখ হাসিনার, আশ্রয় পান ভারতে। তখন ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগকে এক করতে ১৯৮১ সালে দলের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন তিনি। শুরু হয় রাজপথে তার সংগ্রামী জীবনের পথচলা। ১৯৯৬ সালে ভোটে জিতে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আবারও বিরোধী দলে যান শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ শাসন করেন। নানা বিতর্কের মধ্যেও সবশেষ তিনটি নির্বাচনে ক্ষমতা টিকে রাখতে পারলেও এবার গণআন্দোলনের মধ্যে তাকে পদ ও দেশ ছাড়তে হলো। শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভাল। নয়াদিলিস্নর কাছের গাজিয়াবাদে (উত্তর প্রদেশ) সেনাবাহিনীর হিন্দন বিমানঘাঁটিতে স্থানীয় সময় ৫-৩৬ মিনিটে অবতরণ করে শেখ হাসিনার বিমান। সেখানেই শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন অজিত দোভাল। (তথ্য সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে)