বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগের প্রথম দিন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৩ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রোববার দুপুরে এ হামলার শিকার হন তারা। হত্যার পর এক পুলিশ সদস্যের গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখাও হয়! তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের নাম, পরিচয় বা পদবি শনাক্ত করা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টার দিকে হাজার হাজার আন্দোলনকারী লাঠিসোঁটা নিয়ে এনায়েতপুর থানার দিকে আসতে থাকে। পরে একত্রিত হয়ে হাজার হাজার আন্দোলনকারী একযোগে থানায় হামলা চালায়। এ সময় আন্দোলনকারীদের হাতে লোহার রড, লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল। তারা সেখানে সাংবাদিকসহ আশপাশে কাউকে ভিড়তে দেয়নি। থানায় ঢুকেই তারা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ১৩ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এতসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় পুরো এনায়েতপুর এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বিজয় বসাক বলেন, 'আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে এসে এনায়েতপুর থানায় হামলা ও ভাঙচুর চালায়। একপর্যায়ে তারা থানায় আগুন দেন এবং সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যা করেন।'
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। মধ্যযুগীয় কায়দায় যেভাবে থানায় ঢুকে পিটিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। আমরা এ বিষয়ে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেব।'
এনায়েতপুর হাট কমিটির সহ-সভাপতি মোকতার হোসেন বলেন, 'বেলা ১১টার দিকে তিন থেকে চার হাজার আন্দোলনকারী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী থানা ঘেরাওয়ের পর ভাঙচুর শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশ ছাদে উঠে আত্মরক্ষায় রাবার
বুলেট, টিয়ার শেল ও গুলি ছুড়লে অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। পরে তারা থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশ সদসদের ওপর চড়াও হন। এ সময় দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা দিয়ে পুলিশ সদসদের বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। আহত অবস্থায় একে একে সবাই থানা প্রাঙ্গণে বিনাচিকিৎসায় মারা যান।'
এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সৌদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রাশেদুল হাসান সিরাজ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'আন্দোলনকারীরা এ মুহূর্তে নেই। দ্রম্নত মরদেহগুলো উদ্ধার করা উচিত। নতুবা রাতের অন্ধকারে আন্দোলনকারীরা সেগুলো গুম করতে পারে। যতদূর জেনেছি, থানায় ৩৬ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। হয়তো আশপাশে আরও কয়েকজন আহত অবস্থায় পালিয়ে বা ভেতরেও থাকতে পারেন। তাদেরও খুঁজে বের করা উচিত।'
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল বলেন, 'এনায়েতপুর থানার ঘটনাটি মর্মান্তিক। আন্দোলনকারীদের মারধরে নিহত পুলিশ সদস্যদের নাম-পরিচয় ও পদবি শনাক্ত এবং মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর রোমহর্ষক বর্ণনা
এদিকে, ১৩ জন পুলিশকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া গেছে প্রত্যক্ষদর্শী এক স্থানীয় সাংবাদিকের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, মিছিল নিয়ে থানায় হামলা হয়। একপর্যায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। এরপর পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে একে একে বের হতে থাকলে তাদের পিটিয়ে, মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়। হত্যার পর এক পুলিশ সদস্যের গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখার ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। তিনজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে পুকুরে ফেলে রাখা হয়। হত্যা করে আট পুলিশ সদস্যকে স্থানীয় একটি মসজিদের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়। তাদের কয়েকজনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাদের গায়ের পোশাক খুলে ফেলা হয়। থানার পাশেই এক সাংবাদিকের বাড়ি। তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি ওই ঘটনার বর্ণনা দেন।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাও প্রায় একই রকম। তিনি জানান, মিছিলটি থানার দক্ষিণ এলাকা থেকে এনায়েতপুর থানার দিকে আসে। থানার সামনে পুলিশ সদস্যরা মিছিলকারীদের বাধা দিলে সংঘর্ষ বেধে যায়। সেখানে ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলে। এরপর থানায় আগুন দেওয়া হয়।