কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়েছে। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশের জনসমুদ্রে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আমাদের নয় দফা এখন 'এক দফায়' পরিণত হয়েছে। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রোববার থেকে আমরা অসহযোগ আন্দোলন করব। পাশাপাশি দেশের সর্বত্র বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মমূচি পালিত হবে।'
জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই খুনি সরকারকে কোনোভাবে আর সমর্থন দেওয়া হবে না। যদি কোনোভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়, কোনোভাবে কারফিউ বা জরুরি অবস্থা দেওয়া হয়, প্রয়োজনে গণভবন ঘেরাও করে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা হবে।
এদিকে শনিবারের আন্দোলন কর্মসূচিকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, পুলিশের গাড়ি-স্থাপনা ও ক্ষমতাসীন দলের কার্যালয় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ স্পটে পুলিশ সহনশীল ভূমিকা পালন করলেও কুমিলস্না, গাজীপুর, ফরিদপুর, সিলেটসহ অর্ধ ডজনের বেশি জেলায় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তারা। সংঘাত-সংঘর্ষে পুলিশ ও শিক্ষার্থীসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন অন্তত ১৫ জন। গাজীপুরের শ্রীপুরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে এক যুবক নিহত হন।
দুপুরের পর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ শহীদ মিনারে জড়ো হলে আশপাশের কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শুরুর দিকের্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী ও বিজিবি সেখানে টহলরত থাকলেও পরে তারা সেখান থেকে দূরে সরে যায়। শহীদ মিনারে জমায়েত হওয়া আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ সন্ধ্যার দিকে শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেয়।
অন্যদিকে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে রাজধানীর স্পর্শকাতর সড়কের মোড়গুলোতে শনিবার ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ওইসব স্পট থেকে ট্রাফিক পুলিশকে
যানবাহন নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্যান্য মোড় থেকেও ট্রাফিক পুলিশ তুলে নেওয়া হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা খুব দ্রম্নতই ছাত্র-নাগরিক অভু্যত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্রসংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা আমরা সবার সামনে হাজির করব। শুধু শেখ হাসিনা নন, মন্ত্রিসভাসহ পুরো সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এই ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ করতে হবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই- যেখানে আর কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এক দফা কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রচন্ড ক্ষোভ থেকেই সরকার পতনের এই এক দফা দেওয়া হয়েছে বলে তার ধারণা। শিক্ষার্থী ও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছে। এটি তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। এ জন্যই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে। যারা মানুষের বাকস্বাধীনতা নষ্ট করে, নির্বিচারে গুলি ও অত্যাচার করে এ রকম সরকারের শেষ পরিণতি দ্রোহের মাধ্যমে হয়। সরকারকে তাদের আত্মবিবেক জাগ্রত করতে হবে। স্বৈরাচারে অনাস্থা, জনগণে আস্থা- এটাই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে প্রমাণিত হলো।
এর আগে দুপুর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় একত্র হন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। সময় যত গড়াতে থাকে, আন্দোলনকারীদের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে। হাজারো মানুষের ভিড়ে শহীদ মিনার চত্বর ও এর আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। জগন্নাথ হল, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, আরেকদিকে দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে গেছে জনতার ঢল।
শহীদ মিনার এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা 'আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে,' 'জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস,' 'দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত,' 'স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে,' 'জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো,' 'বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর', 'ছাত্র-জনতার অভু্যত্থান, অভু্যত্থান', 'পদত্যাগ পদত্যাগ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ' এমন নানা সেস্নাগান দেন। শহীদ মিনারে সামনের সারিতে অন্তত ছয়জন সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুলস্নাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও আবদুল কাদের। তাদের মধ্যে নাহিদসহ তিনজন বক্তব্য দেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রিকশায় বাঁধা মাইক দিয়ে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ ঘোষণা দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। ঘোষণায় বলা হয়, আপনারা সবাই শাহবাগ চৌরাস্তা মোড়ের দিকে অগ্রসর হন। এরপর জনতার স্রোত দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মূল শহীদ মিনারে অবস্থান নিতে থাকে একটি দল। অপর দলটি শহীদ মিনার থেকে সেস্নাগান দিতে দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারের পাশের ও জগন্নাথ হলের পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে শাহবাগের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় তারা এক দফা দাবির সেস্নাগান দিতে থাকেন। তাদের দাবি, যে সরকারের হাত ছাত্রদের রক্তে লাল হয়েছে, সেই সরকারকে তারা আর ক্ষমতায় দেখতে চান না। হাজার হাজার মানুষ হাঁটতে শুরু করে শাহবাগের দিকে। এ সময় আন্দোলনকারীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নানা ধরণের সেস্নাগান দিতে দিতে এগুতে থাকে। অধিকাংশ সেস্নাগানই তারা মুখে দেন। তবে হ্যান্ড মাইক ও বড় বড় মাইক দিয়েও তখন সরকারবিরোধী সেস্নাগান দেওয়া হচ্ছিল।
এমন অবস্থার মধ্যেই মাগরিবের নামাজের আজান হয়। অনেকেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে নামাজ আদায় করেন। মুসলিস্নর সংখ্যা অধিক হওয়ায় মসজিদে দুই বার জামাত হয়। এরপর মসজিদ থেকে বেরিয়ে অনেকেই শাহবাগের দিকে রওনা হন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিতে। আবার অনেকেই শহীদ মিনারে অবস্থান করার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। পুরো এলাকা তখন সেস্নাগানে সেস্নাগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। অনেকেই আতঙ্কে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। বিশেষ করে ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে আসা অভিভাবকরা সন্ধ্যার আগেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আর তরুণী ও যুবতী মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে আসা মা-বাবারাও মাগরিবের নামাজের পরপরই যার যার গন্তব্যের দিকে চলে যান। আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ আশপাশের সব প্রতিষ্ঠানের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরীরা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারের ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ভেতরে প্রবেশ করতে আন্দোলনকারীদের অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করা হচ্ছে। কারণ ভেতরে শিক্ষকদের পরিবার রয়েছে। সে জন্য আন্দোলনকারীরাও আর ভেতরে প্রবেশ করেননি। তবে অনেক আন্দোলনকারীকে কোয়ার্টারের ভেতর থেকে পানি সরবরাহ করা হয়েছে।
শাহবাগের দিকে একটি অংশ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারে আন্দোলনরত রিকশা চালকরা চলে যান। তারা আগের মতোই যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে সন্ধ্যার পরপরই পুরো শহীদ মিনার এলাকার রাস্তার বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণে পুরো এলাকা ছিল দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মূল শহীদ মিনারে থাকা আলোও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শহীদ মিনারে অবস্থান করে পর্যায়ক্রমে বক্তব্য দিতে থাকেন।
শাহবাগের দিকে আসা আন্দোলনকারীদের অপর অংশটি প্রথমে টিএসসি এলাকায় অবস্থান নেন। বিশেষ করে আন্দোলনকারীদের বড় একটি অংশ রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেয়। তারা সেখান থেকেই সরকারবিরোধী সেস্নাগান দিতে থাকেন। এ সময় তাদের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা হাতে নানা ধরনের সেস্নাগান দিতে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে রয়ে যান আন্দোলনকারীদের কয়েক হাজার সদস্য।
অপর অংশটি মাইক নিয়ে সেস্নাগান দিতে দিতে অগ্রসর হতে থাকেন শাহবাগ চৌরাস্তা মোড়ের দিকে। এ সময় মাইকের পেছনে পেছনে শত শত আন্দোলনকারীকে সেস্নাগানের সঙ্গে তাল মেলাতে দেখা যায়। শাহবাগ থানার সামনে যাওয়ার পর আন্দোলনকারীদের অংশটি আবার ভাগ হয়ে যায়। বড় একটি অংশ অবস্থান শাহবাগ থানার মূল গেটের সামনে। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার সময় অনেক পুলিশকে চেয়ার পেতে শাহবাগ মডেল থানার সামনে অস্ত্র হাতে সতর্ক অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে। আন্দোলনকারীরা শাহবাগের দিকে রওনা হওয়ার পর পুলিশ সদস্যদের শাহবাগ মডেল থানার ভেতরে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। মূল গেট বন্ধ করে প্রচুর পুলিশ সেখানে আলো নিভিয়ে অবস্থান করছিল। এ সময় আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেয়। তারা পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে ভুয়া ভুয়া সেস্নাগান দিতে থাকে। যদিও এ সময় পুলিশের তরফ থেকে কোনো ধরনের উচ্চবাচ্য করার শব্দ শোনা যায়নি। আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থানার সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সেস্নাগান দিতে থাকলেও তাদের মধ্যে মারমুখী কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি।
অপর অংশটি শাহবাগ মোড়ের ঠিক মাঝখানে বসে নানা সেস্নাগান দিচ্ছিল। তারা নানা ধরনের কোরাস গাইছিল। পুরো এলাকায় কোনো পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। এমনকি বাইরে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। সেখান থেকে আরেকটি অংশ ফার্মগেটের দিকে রওনা হয়। আন্দোলনকারীদের এই দলটি ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট। সেখানে নারী, মধ্য বয়স্ক মহিলা থেকে শুরু করে নানা বয়সি মানুষজন ছিল। তাদের সবার মুখেই ছিল সরকারবিরোধী সেস্নাগান। এছাড়া হ্যান্ডমাইক ও বড় মাইক দিয়েও আন্দোলনকারীদের সেস্নাগান দিতে দিতে ফার্মগেটের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। এ সময় পাঁচতারকা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল (সাবেক শেরাটন) মোড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় সাধারণ মানুষ ও আন্দোলনকারীদের ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এদিকে শাহবাগ থেকে মিন্টো রোডের দিকে এগুতেই পুলিশের পুরো বেরিকেড দেওয়া। পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল মামুনের সরকারি বাসভবনের সামনে মোতায়েন ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ। এছাড়া মিন্টো রোডের সব সড়ক বাতি ছিল নেভানো। পুরো রাস্তাজুড়ে গাছের নিচে পুলিশ সদস্যদের সতর্ক অবস্থায় দেখা গেছে। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পুলিশ কাঁটাতারের বেরিকেড ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। তবে যানবাহন চলাচল করার জন্য মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা রেখেছে। যাতে করে দ্রম্নতগতিতে কোনো যানবাহন চলাচল করতে না পারে। যাতায়াতকারীদের অনেকেরই পরিচয় জানতে চাইতে দেখা যায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের। তবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কোনো বিদেশি সাংবাদিক ও বিদেশি নাগরিক এবং ফটোসাংবাদিককে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাহবাগসহ কোথাও দেখা যায়নি। রাত সাড়ে ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও তারা শাহবাগে বিক্ষোভ করছিলেন। তখনো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজারো মানুষ অবস্থান করছেন। রাজু ভাস্কর্যেও বিক্ষোভ চলছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় নিহত ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও ৯ দফা দাবি আদায়ে মিরপুর-১০ গোল চত্বরে প্রায় চার ঘণ্টা বিক্ষোভ শেষে করে সড়ক ছাড়েন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় ১০ নম্বর গোল চত্বরে জড়ো হয়ে এই বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় পরবর্তী কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়ে ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় মিরপুর-১০ দিয়ে চলাচল করা গাড়িগুলো মিরপুর-২ দিয়ে যাতায়াত করে। বিক্ষোভ শেষে ৪টা ৫০ মিনিটে আবারও যাতায়াত স্বাভাবিক হয়।
এই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মিরপুর-১০ এর পশ্চিম পাশে পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়। পরে বিক্ষোভ শুরু হলে সোয়া ১টায় মিরপুর মডেল থানার ডিসি, এডিসি, ওসিসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের কাছে ডেকে কথা বলেন। তারা আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিতে বলেন। কোনো বহিরাগত এসে যেন কোনো ধরনের সহিংসতা করতে না পারে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেন শিক্ষার্থীদের। দুপুর ২টার পর আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময় তা বিশাল স্রোতে রূপ নেয়। আলাদা দলে দলে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও এসে যোগ দেন বিক্ষোভে। অনেক অভিভাবকও তার সন্তানদের সঙ্গে আসেন নিরাপত্তা স্বার্থে।
অভিভাবকরা জানান, চেষ্টা করেও তাদের সন্তানদের বাসায় রাখা যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সন্তানকে নজরে রাখতে নিজেই নিয়ে এসেছেন। বিক্ষোভের পুরোটা সময় পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মিরপুর অরিজিনাল ১০-এ শুরুতে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিলে পরে তারা সরে যান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে রওনা হন। বিকাল ৩টার দিকে সায়েন্সল্যাব থেকে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহত, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানির প্রতিবাদে ব্যান্ড সংগীতশিল্পীরা বিকাল ৩টায় ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে জড়ো হন। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানাতে সংগীতশিল্পীরা শহীদ মিনারে রওনা দেন। মিছিল নিয়ে বিকাল পৌনে চারটার দিকে তারা শহীদ মিনার এলাকায় পৌঁছান।
এদিকে শান্তিনগর, আফতাবনগর, প্রগতি সরণি, বাড্ডা, রামপুরা, শনির আখড়া এলাকায় আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ঢাকায় এই বিক্ষোভ কর্মসূচির প্রতিটি পয়েন্টেই পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে।
রাজধানীর কাজলা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এতে কাজলা থেকে রায়েরবাগ এলাকা পর্যন্ত ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজলা, যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকায় মহাসড়কে কয়েকশ' আন্দোলনকারীকে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তাদের অবস্থানের কারণে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হলেও অ্যাম্বুলেন্স যেতে দেওয়া হয়।
বিকালে সরেজমিন ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কাজলায় পথচারী সেতুর নিচে শতাধিক মানুষ অবস্থান করছে। পদচারী সেতুর ওপরে বেশ কয়েকজন অবস্থান নিয়েছেন। যাত্রাবাড়ী থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। দনিয়া কলেজের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, 'শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। কোনো যানবাহন চলতে দিচ্ছেন না। তাদের সড়ক ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।'
রাজধানীর উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের পাশের রাস্তায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকরাও ছিলেন। দুপুর দেড়টার দিকে দেখা যায়, বিএনএস সেন্টারের সামনে অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে ছাউনি বানিয়ে অবস্থান করছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি দল বিএনএস সেন্টারের নিচে অবস্থান করছেন।
বিএনএস সেন্টারের পেছনের গলিতে দাঁড়ানো অভিভাবক মাহফুজ কামাল বলেন, 'আমরা এসেছি আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য। আমরা শান্তি চাই। আর একটা গুলিও নয়। এই গুলি আমাদের টাকায় কেনা।' অভিভাবকদের অনেকে বলেন, 'ওরা গুলি করুক, আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করব। কেউ ভয়ে পালিয়ে যাব না।'
বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর আফতাবনগরে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে রামপুরা ব্রিজ থেকে আফতাবনগর যাওয়ার রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে দুপুর ২টার দিকে রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরুল বাড্ডা পর্যন্ত সড়কে নেমে আসেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষার্থী। এ সময় রাস্তায় পুলিশ অবস্থান করলেও ছাত্রদের উপস্থিতি বাড়লে তারা সরে যান। এর আগে সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলসহ শিক্ষার্থীদের ঢল নামে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অভিভাবকদেরও যোগ দিতে দেখা গেছে।
বাড্ডা থানার ওসি আবু সালাম বলেন, 'আমরা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আন্দোলনকারী যেসব শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছেন তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। আন্দোলনকারীরা আমাদের জানিয়েছেন তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবেন। নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যেন কেউ নাশকতা করতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে।'
কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে প্রগতি সরণি সড়কে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে ও শান্তিনগর মোড়ে বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছেন। এসব এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়।