ইভিএম :অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত!

সুফল মেলেনি রাষ্ট্রের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবে সায় নেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

বীরেন মুখার্জী
প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর পর চলতি বছরের জুনে শেষ হয়েছে বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের মেয়াদকাল। 'প্রকল্প প্রস্তাবে' মেশিনের জীবনকাল ১০ বছর উলেস্নখ থাকলেও পাঁচ বছরের মধ্যেই বেশির ভাগ মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা যায়নি। বর্তমানে শতভাগ ত্রম্নটিমুক্ত মেশিন একটিও নেই। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এক লাখের বেশি। ইভিএম প্রকল্পে রাষ্ট্রের প্রায় চার হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হলেও কোনো সুফল মেলেনি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় মেশিনগুলো নষ্ট হয়েছে। দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে কিছু মেশিন মেরামতের পর ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বিশ্লেষকদের দাবি, অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণ করায় ইভিএমগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র মতে, দ্বিতীয়বার প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষের এক মাস পেরিয়ে গেলেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। উন্নতমানের এই ভোটযন্ত্রগুলোর সুরক্ষায় তাদের নিজস্ব সংরক্ষণ ব্যবস্থাও নেই। এ জন্য মেশিনগুলোর সুরক্ষায় অঞ্চলভিত্তিক ওয়্যারহাউজ নির্মাণের দিকে যাচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি। তথ্য অনুযায়ী এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেশের ভোটব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। কমিশন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে মেশিন তৈরি করে। এরই ধারাবাহিকতায় কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোটযন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরবর্তী সময় ওই কমিশন বুয়েটের তৈরি স্বল্পমূল্যের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তসহ উন্নতমানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কে এম নূরুল হুদার কমিশন ২০১৭ সালে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেন তারা। এতে মেশিনপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা। হাতে নেওয়া হয় তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প। একনেকে পাস হয় প্রকল্পটি। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্প থেকে দেড় লাখ ইভিএম কেনে রকিব কমিশন। কিন্তু গৃহীত প্রকল্প প্রস্তাবে সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ব্যবস্থা না থাকায় উন্নত মানের ইভিএমের মেয়াদ ১০ বছর হলেও পাঁচ বছর যেতে না যেতেই অকেজো হওয়া শুরু করে। সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের ৫ বছর মেয়াদ শেষ হয়। তখন ইসির প্রস্তাব অনুযায়ী আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ায় পরিকল্পনা কমিশন। এরই মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এসে যায়। কিন্তু এ সময় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী পড়ে। অবশিষ্ট এক লাখ ১০ হাজার মেশিনের বেশির ভাগে ধরা পড়ে নানা ধরনের ত্রম্নটি। কিন্তু মেরামতের জন্য ছিল না নতুন কোনো অর্থের জোগান। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ ইত্যাদির জন্য সাড়ে ১২শ' কোটি টাকার প্রস্তাব দিলেও সরকার বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে সেটি নাকচ করে দেয়। যে কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের পথে হাঁটে ইসি। এরপর চলতি বছর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কিছু কিছু এলাকায় ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হলেও ত্রম্নটির কারণে দুর্ভোগে পড়তে হয় ভোটারদের। আবারও সমালোচনার মুখে পড়ে ইভিএম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একনেকে প্রকল্পটি পাসের আগে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের এক সভায় প্রকল্পটির বিষয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্ত ছিল। এর মধ্যে ছিল ইভিএমগুলো সংগ্রহ করার পর সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ইভিএমের ১০ বছরের ওয়ারেন্টির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণ অঙ্গের বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন দিতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি যেভাবে পাস হয়, তাতে ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা খাত ছিল না। একসঙ্গে দেড় লাখ ইভিএম না কিনে পর্যায়ক্রমে কেনার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সেটাও মানা হয়নি। এসব ইভিএম কেনার আগে পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে ইসি। কমিটি এই ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ওই সুপারিশও তখন আমলে নেয়নি ইসি। ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, বর্তমানে এক লাখ ১০ হাজার মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী। আর ৪০ হাজারের মতো মেশিন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাচ্ছে। তবে শতভাগ ত্রম্নটিমুক্ত মেশিন একটিও নেই। সব মেশিনেই কোনো না কোনো সমস্যা আছে। তবে সেগুলো সারিয়ে নির্বাচনে ব্যবহার করা যেতে পারে। দক্ষ লোকবলের অভাবকে দায়ী করে তিনি জানান, প্রকল্প থাকলেও সেখানে দক্ষ কারিগরি লোকবল নেই। যারা ছোটখাটো সমস্যা হলে সমাধান করতে পারে। আগেও যে ইভিএম ছিল তখনো কারিগরি লোকবল নিয়ে ভাবনা হয়নি। এখনো নেই। এছাড়া সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি প্রকল্পে। এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্র মতে, দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছে ১ লাখ ২ হাজার ইভিএম রয়েছে। যার মধ্যে ২০ হাজার ব্যবহার উপযোগী। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ৪৬ হাজার ইভিএম রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাকিগুলোও কমবেশি মেরামত করতে হবে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ একেবারেই ব্যবহার অনুপযোগী। সূত্র মতে, অকেজো ইভিএমগুলো মেরামতে বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। মেরামত করার পর আবার এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টাকা ও জনবল লাগবে। এগুলো রাখার জন্য ভাড়াবাবদ ইতোমধ্যে ৫০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া জমেছে। তবে এগুলো মেরামতের জন্য সরাসরি টাকা চাইবে না ইসি। তারা পরিস্থিতি তুলে ধরে সরকারকে চিঠি দেবে। এ ক্ষেত্রে ইসির হাতে আরেকটি বিকল্প হলো যন্ত্রগুলো ধ্বংস (ডিসপোজ) করে ফেলা। ইভিএমের এমন পরিস্থিতির জন্য মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন ইভিএম প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ইভিএম মেশিনগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। জেলাপর্যায়ে এসব মেশিন স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা জায়গায় সংরক্ষণ করায় এগুলো দ্রম্নত নষ্ট হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, মাঠপর্যায়ে থাকা কিছু কিছু ইভিএমের ভেতরে পানি, বালু পাওয়া গেছে। আবার কোনোটির কেবল ছেঁড়া, কোনোটির বোতাম নেই। কোথাও পুড়েছে আগুনে। কোনো অঞ্চলে আবার চুরি হয়েছে ইভিএম সেটসহ মনিটর। কিছু ইভিএমের মনিটর ভাঙা অবস্থায় দেখা গেছে। উইপোকা ও তেলাপোকার কারণেও এগুলো নষ্ট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইভিএমের দুরবস্থার বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ একটি সংবাদমাধ্যমে বলেন, 'ওয়্যার হাউজের অভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইভিএম নষ্ট হয়েছে। এখানে ইসির কোনো অবহেলা ছিল না।' তবে কী পরিমাণ ইভিএম ভালো আছে, সেটা কিউসির ফলাফল পেলে জানা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'যদি অনেক বেশি মেরামত করার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন। বেশি টাকার প্রয়োজন হলে সেটা তো আমাদের কাছে নেই। প্রজেক্টের বেশি টাকা নেই। সেখানে মাত্র ৬০ কোটি টাকা আছে। তার মধ্য থেকেই করতে হবে। যদি এর বেশি প্রয়োজন হয়, সেটা তো অর্থ মন্ত্রণালয় এখন দেবে না।' দেশের রাজনৈতিক মহলে বহুল বিতর্কের জন্ম দেওয়া এই ইভিএমের এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে, গত জুলাইয়ের ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় ওয়্যারহাউজ নির্মাণের আলোচনার পর ইভিএম প্রকল্প পরিচালক ও সব আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন সংস্থাটির সচিব শফিউল আজিম। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ইভিএম সংরক্ষণের জন্য অঞ্চলভিত্তিক ওয়্যারহাউজ তৈরির খসড়া ডিজাইন, জমি এবং অন্যান্য ব্যয়ের প্রাক্কলন দিতে হবে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের চাহিদাও পাঠাতে হবে। তবে ইসি সচিব জানান, ইতোমধ্যে তারা ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে একটি ওয়্যারহাউজ তৈরির জন্য জমি চেয়েছেন। জমি পেলে ইভিএম সংরক্ষণসহ সার্বিক ব্যবস্থা নেবে কমিশন।