জামায়াতে ইসলামীকে কোন প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা হবে, সেটি নিয়ে সরকারের মধ্যে নানা আলোচনা চলছে। মঙ্গলবার সরকারের একাধিক মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ১৪ দল যে কথা বলছে, সেটি বাস্তবায়ন করবে সরকার। তবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে, এর আইনগত দিক দেখেশুনে সরকার শিগগিরি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। আমরা আইনগত দিকটি ভালোভাবে দেখে নিতে চাই। যাতে কোন ফাঁকফোকর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এই অপশক্তি আর কোনো সুযোগ না পায়।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে গত ১২ বছর যাবত সরকারের ভেতরে কয়েকটি উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও এ ধারণাই দিয়েছেন।
একটি হচ্ছে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আদালতে আবেদনের মাধ্যমে হতে পারে। আরেকটি বিকল্প হচ্ছে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।
এ ছাড়া সংসদেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সবকটি বিকল্প বিবেচনা করছিল ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু এই ইসু্যতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হতে হলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার হতে হবে। সে ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রয়োজন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ধারণা দিয়েছেন, সরকার হয়ত নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করবে।
তিনি বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, বুধবারের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা আমরা যখন সিদ্ধান্ত নেব তখন বলব। যদি এই দলটাকে নিষিদ্ধ
করা হয়, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে।'
মন্ত্রী বলেন, 'যখন (কোনো দল) নিষিদ্ধ হয় তখন নির্বাহী আদেশে হয়, বিচার বিভাগীয় আদেশে হয় না।'
নিষিদ্ধ করলে কী হবে?
বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত রয়েছে গত এক দশকের বেশি সময় যাবত।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। দলটির নেতাকর্মীরা কোনো বাসায় বসলেও সেখানে পুলিশর হানা দেওয়া ও গ্রেপ্তারের খবর প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
২০১৩ সালের ১০ জুন এক দশক পর ঢাকায় প্রকাশ্যে সমাবেশ করেছিল জামায়াতে ইসলামী।
এমন অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিকে 'হাস্যকর' হিসেবে বর্ণনা করেছেন দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবর।
তিনি মনে করেন, গত ১৫ বছর যাবত জামায়াতের ইসলামী যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এতে দলটিকে নিষিদ্ধ করা কিংবা না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
তিনি বলেন, 'তাদের নিষিদ্ধ করা হলো কি হলো না, দ্যাট ডাজ নট ম্যাটার (এটা কোনো ব্যাপার না)।' তিনি মনে করেন, ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে গিয়ে যে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে সেখান থেকে 'দৃষ্টি ভিন্ন দিকে' নেওয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামীর ইসু্যটিকে ক্ষমতাসীনরা সামনে এনেছে।
তবে নিষিদ্ধ করার পর এর একটি আইনগত ভিত্তি হয় বলে উলেস্নখ করছেন পর্যবেক্ষকরা। যখন কোনো ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ফেসবুক কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রচারণা চালায় তখন তাকে আইনের আওতায় আনতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি জামায়াতে ইসলামীকে আর্থিক সাহায্য কওে, তাহলে তাকেও আইনের আওতায় আনা যাবে।
কারণ, নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষে প্রচারণা চালানো এবং তাদের আর্থিক সহায়তা করা দন্ডনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেই সংগঠনের ব্যানারে কোনো সভা-সমাবেশ কিংবা অন্য কোনো ধরনের তৎপরতা চালানো যায় না।
এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে গেলে সরকার তাদের আইনের আওতায় আনতে পারবে বলে তিনি উলেস্নখ করেন।
সরকার এতদিন যা বলেছে
২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলও খারিজ হয়ে যায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা নিষিদ্ধ ছিল না।
সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ট্রাইবু্যনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর পর ১০ বছর পার হলেও সে বিচার এখনো শুরু হয়নি।
২০১৯ সালের ৬ ফেব্রম্নয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হবে কিনা, সেটি জানতে আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, রায় শিগগির হবে।
তিনি বলেছিলেন, 'তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য ইতোমধ্যে কোর্টে একটি মামলা রয়ে গেছে। সেই মামলার রায়টা যতক্ষণ পর্যন্ত না হবে, সেখানে বোধ হয় আমরা কোনো কিছু করতে পারি না। আমি আশা করি, কোর্টের রায় খুব শিগগিরই হয়ে যায়, তাহলে জামায়াত তারা দল হিসেবে নিষিদ্ধ হবে।'
তবে প্রধানমন্ত্রী কোন মামলার কথা বুঝিয়েছেন, সেটি তিনি পরিষ্কার করে বলেননি। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য আলাদা কোনো মামলা হয়নি।
২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য উপযুক্ত আইন থাকতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবু্যনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধন করা হচ্ছে। এটা মন্ত্রিপরিষদের অ্যাপ্রম্নভালের জন্য অপেক্ষমাণ।'
এরপর ২০২৩ সালের ১১ জুন আনিসুল হক ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে আবারও একই উত্তর দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, 'জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য যে আইন সংশোধন করার কথা আমি আগে বলেছি, সে প্রক্রিয়া কিন্তু চলমান এবং সংশোধনের জন্য আইনটা কেবিনেটে কিছুদিনের মধ্যে যাবে।'
এর আগে ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি বিবিসি বাংলার এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়, সেই হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ডও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
পরে ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এরপর প্রথমে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ হিসেবে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী আবার কর্মকান্ড শুরু করে। তবে ১৯৭৯ সাল থেকে নিজেদের নামেই কর্মতৎপরতা শুরু করে।