আরও দুই সমন্বয়ককে 'তুলে নেওয়ার' অভিযোগ
প্রকাশ | ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৮
যাযাদি ডেস্ক
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম এবং আরিফ সোহেলকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তাদের পরিবার।
নুসরাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। তাকে রোববার ভোরে মিরপুরের রূপনগরের বাসা থেকে ডিবি পুলিশের পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
আর আরিফ সোহেল কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) একজন সমন্বয়ক ছিলেন। তার পরিবার জানিয়েছেন, শনিবার রাত সোয়া ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী ৮-৯ জনের একটি দল আরিফ সোহেলকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তারা ডিবি পুলিশের পরিচয় দেয়।
রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন-অর রশীদ নিশ্চিত করেন, 'নিরাপত্তার স্বার্থে' নুসরাতকে ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে। তবে, আরিফ সোহেলের বিষয়টি সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাভারের আশুলিয়া থানা কিংবা ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা যায়নি।
এর আগে শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুলস্নাহকে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের 'হেফাজতে' নিয়েছে। এর আগে শুক্রবার বিকালে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত
অবস্থায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে 'তুলে নিয়ে যাওয়ার' অভিযোগ উঠে।
নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ
নুসরাত তাবাসসুমের ফুফাতো বোন মেহের নিগার মিষ্টি জানিয়েছেন, ভোরে মিরপুরের রূপনগরের যেই বাসা থেকে নুসরাতকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তারা। মিষ্টি বলেন, 'ভোরে মূল গেট ভেঙে সাদা পোশাকে একদল ব্যক্তি বিল্ডিংয়ে ঢুকে চারতলার দুটি ফ্ল্যাটে দরজা ভেঙে ফেলে। তারা নুসরাতকে ঠিকমতো পোশাক পরিবর্তনের সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। এক নারীও ছিল তাদের সঙ্গে। ডিবি পরিচয় দিয়ে তারা নুসরাতকে নিয়ে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, নুসরাতকে বাসা থেকে নেওয়ার সময় কোথায় নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে, তারা শুধু মিন্টো রোডে ডিবি অফিসে খোঁজ নেওয়ার জন্য বলেছে।
প্রসঙ্গত, নুসরাত তাবাসসুম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এবং তার ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি নিজেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যুগ্ম সদস্যসচিব এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এবারের কোটাবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
আরিফের পরিবারের অভিযোগ
আরিফ সোহেলের বাবা মো. আবুল খায়ের বলেন, রাতে দুটি কালো গস্নাসের মাইক্রোবাসে করে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
তিনি বলেন, 'তাদের সবার হাতে অস্ত্র ছিল। বাড়ির গেটে এসে গেট খুলতে বলল। পরিচয় জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের কথা বলে। তারা বলল, আংকেল গেট খুলেন। একটু চা খাব। আমরা সরকারের লোক। এরপর গেট খুলে দিলে বাড়িতে এসে সার্চ শুরু করে। সবার মোবাইল ফোন জব্দ করে নেয়।'
আবুল খায়ের জানান, তলস্নাশি শেষে তার ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। সঙ্গে বড় ছেলেকেও নিয়ে যায়। তবে পরে বড় ছেলেকে কিছুদূর এগিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।
আরিফ সোহেলের পরিবার বলেছেন, আরিফ সোহেলকে আটকের সময় আশুলিয়া থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়। তবে ভোরেই তারা আশুলিয়া থানায় গেলে সেখান থেকে কাউকে আটকের কথা স্বীকার করা হয়নি।
আরিফ সোহেলের বাবা আবুল খায়ের বলেন, 'আমরা উদ্বিগ্ন। তাকে কোথায় নেওয়া হয়েছে, সেটা জানতে পারছি না।'
পুলিশের ভাষ্য
রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন-অর রশীদ সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন, 'নিরাপত্তার স্বার্থে' নুসরাতকে ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে। তবে, আরিফ সোহেলের বিষয়ে জানতে আশুলিয়া থানায় যোগাযোগ করা হলে থানার অপারেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা জানান, তাদের পক্ষ থেকে আরিফ সোহেল নামে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মোট পাঁচজনকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবির 'হেফাজতে' নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
শনিবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, 'গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে জানতে ও তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।'
জাবি শিক্ষকদের সমাবেশ
এদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
রোববার দুপুর ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ফজিলাতুন্নেসা হল সংলগ্ন নবনির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে শিক্ষকদের এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের হত্যা, তাদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানান শিক্ষকরা। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, 'কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের ওপর হামলা করা হয়েছে। এখন আবার যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের নিরাপত্তার কথা বলে তুলে নেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা জানি, শিক্ষার্থীদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।'
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বলেন, 'সারাদেশে যা ঘটে যাচ্ছে, এতে আমরা ভীষণভাবে মর্মাহত। এই সরকার যেভাবে হত্যাকান্ড চালিয়েছে, আমরা যাদের স্বৈরাচার বলতাম, তাদের আমলেও এমন হত্যাকান্ড ঘটেনি। যে বাহিনীকে আমরা মনে করতাম, জনগণের নিরাপত্তা দেবে, সেই বাহিনীকেই সরকার তার নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষার্থী ও জনগণের ওপর লেলিয়ে দিয়েছে।'
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরীর সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস প্রমুখ।