বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১
ঢাকার সিএমএম কোর্ট

প্রিয়জনের প্রতীক্ষায় স্বজনরা

দিনের পর দিন ঘুরছেন আদালতে, চেহারায় ক্লান্তি-বিষাদের ছাপ
গাফফার খান চৌধুরী
  ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ২৯ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৭
প্রিয়জনের প্রতীক্ষায় স্বজনরা

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানার সামনে প্রচন্ড ভিড়। তিল ধারণের জায়গা নেই। একেকটি প্রিজনভ্যান আসার সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন স্বজনরা। তারা নাম ধরে ডাকাডাকি করছেন। কেউবা স্বজনদের সন্ধান জানতে পারছেন, অনেকে জানতেও পারছেন না। প্রিয়জনের খবর না পেয়ে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।

রোববার দুপুর পৌনে ১২টায় সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে ঢাকার সিএমএম আদালত চত্বরে। আদালতের হাজতখানার সামনে পলিথিন ব্যাগে কাপড় আর ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঝবয়সি একজন। চেহারায় ছিল ক্লান্তি-বিষাদের ছাপ। তীব্র রোদ আর গরমের সেই ছাপ আরও স্পষ্ট হয়েছে। শরীর দিয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছে। উদভ্রান্তের মতো আদালতের সামনের রাস্তায় এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছেন। আবার থেমে বিশ্রামও নিচ্ছেন।

কাছে গিয়ে ঘটনা জানতে চাইলে, খানিকটা অসন্তোষ ফুটে ওঠে তার চেহারায়। পরিচয় দিয়ে নানা প্রসঙ্গ শেষে মূল ঘটনা জানতে চাইলে একরাশ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'আমার নাম বাচ্চু। নিজের সব কাজ ফেলে সকাল থেকে আদালতে দাঁড়িয়ে আছি। যখন কোনো প্রিজনভ্যান আসছে, তখন কামাল মামা, কামাল মামা বলে জোরে জোরে ডাকাডাকি করছি। যাতে কোনো প্রিজনভ্যানে থাকলে অন্তত হাত নাড়লেও শান্তি পাব। অন্তত জানতে পারব মামা কোথায় আছেন কাদের হেফাজতে আছে।

তিনি আরও বলেন, সকাল থেকে মামাত ভাই জাহিদকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে পুরো আদালত চত্বর চষে বেড়িয়েছি। অনেকটা হতাশ হয়েই গারদখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পাব্যথা হয়ে গেছে। মামার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। মামী শিরিন আক্তারও এসেছেন। তিনি একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি, অথচ মামার খোঁজ পাচ্ছি না। মামা হার্টের রোগী বলে খুব টেনশন হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, মামার পুরো নাম কামাল হোসেন। বয়স ৫৭ বছর। পিতার নাম মৃত সিদ্দিক হাওলাদার। মায়ের নাম মৃত আমেনা বিবি। বাসা আদাবর থানার ঠিক পেছনেই। মামা পেশায় একজন ব্যবসায়ী। এলাকায় অনেকেই তাকে চেনেন। তার অফিসে অনেক পুলিশ

কর্মকর্তা যাতায়াত করেন। বিশেষ করে আদাবর থানার পুলিশের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গেই মামার পরিচয় আছে। কাছাকাছি বসবাস করার সুবাদে স্বাভাবিক কারণেই পরিচয় হয়ে গেছে।

ভাগিনা বাচ্চুর অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে এত ভালো সম্পর্ক থাকার পরও মামাকে শনিবার রাত ৮টায় বাসায় ঢুকে আদাবর থানা পুলিশই ধরে নিয়ে গেছে। ওই সময় মামা নিজের বাসায়ই ছিলেন। মামা কোনো রাজনীতি করেন না। তিনি যে ব্যবসায়ী সেটি শুধু আদাবর থানা পুলিশ না, আশপাশের অনেকেই জানেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় আদাবর থানায় দায়েরকৃত মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে মামাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর পরই মামা অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারণ তিনি আগে থেকেই হার্টের রোগী। রাতেই পুলিশ তাকে আগারগাঁও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে সরাসরি তাকে আদালতে হাজির করার কথা। অথচ খবর নেই।

পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, আপনারা আদালতে গিয়ে উকিল ধরুন। তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে আমরা তাই করেছি। কিন্তু মামার হদিস নেই। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেলেন।

পাশে ময়লা শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত ৬৫ থেকে ৭০ বছর বয়সি এক বৃদ্ধকে দেখা গেল। তিনি রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ শুধুই আদালত চত্বরে আসা প্রিজনভ্যানের দিকে। ভ্যান আসামাত্রই আবু হানিফ আবু হানিফ বলে ডাকছেন। কোনো সাড়া নেই। পরে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, আমার নাম আবু কাশেম। আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন বরফা এলাকার গোলাকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। আমার দুই ছেলে। বড় ছেলে আবু হানিফ। বয়স ৩৭ বছর। সে ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করে। গত ২৬ জুলাই ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে একদল ব্যক্তি বাসা থেকে নিয়ে গেছে। এরপর রূপগঞ্জ থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় আবু হানিফের খোঁজ করেছি। কেউ আবু হানিফের তথ্য দিতে পারেনি। বেঁচে আছে কিনা, তাও জানি না। এজন্য বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে গেছি। সেখানেও পাইনি। তার ছেলে সংঘর্ষের সময় বাসাতেই ছিল। তার ছেলে কোনো ধরনের নাশতকায় জড়িত থাকতে পারে না। পিতা হিসেবে এটা আমার বিশ্বাস।

পাশে থাকা ছোটভাই ও বোন বলছিলেন, রাজনীতি করা কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ হচ্ছে রাষ্ট্র বা ধ্বংসাত্মক অর্থাৎ আইনবিরোধী কোনো কাজ করা। তার ভাই কোনোভাবেই আইনবিরোধী কাজে জড়িত নয়। এক ভাইয়ের রোজগারে সংসার চলে। আমাদের আবার কিসের রাজনীতি। দিন কাটে পেটে ভাতের জোগান দেওয়ার চিন্তায়। তাদের কী আর রাজনীতি বা ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড করা সাজে! প্রশ্ন করেন তিনি। বিগত ৯ দিন ধরে তার ভাইয়ের কোনো খোঁজখবর নেই। আমরা আদালত চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান। সম্ভাব্য সব থানায় গেছি। পুলিশ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। আবার নিখোঁজের জিডিও নেয়নি।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, এমন অবস্থা শুধু কামাল হোসেন বা আবু হানিফের নয়। ঢাকার পুরো আদালত চত্বরজুড়েই এমন দৃশ্য হরহামেশাই চোখে পড়েছে। আসামির চাপ বাড়ায় এবং আদালত চত্বরে রীতিমতো তীব্র যানজট। একদিকে বাড়তি আসামি নিয়ে অতিরিক্ত প্রিজন ভ্যানের আদালতে যাতায়াত, তার ওপর আবার সপ্তাহের প্রথম দিন। অফিস আদালত খোলা থাকায় সেই যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। নিরাপত্তা আর যানজটের কারণে আদালত চত্বরের প্রতিটি গেট বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। প্রতিটি গেটে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। আদালত চত্বরে প্রবেশের ক্ষেত্রে সন্দেহভাজনদের প্রতিটি গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তারা।

সরেজমিন দেখা গেছে, পুরো আদালত চত্বরের কোথাও যেন পা ফেলার জায়গা নেই। অথচ আদালত চত্বরে কোনো যানবাহনও রাখতে দেওয়া হয়নি। আদালত চত্বর লোকে-লোকারণ্য। যেদিকে তাকানো যায় শুধু আইনজীবী, পুলিশ, বিচারপ্রার্থী, নিখোঁজ বা গ্রেপ্তার হওয়াদের স্বজনদের ভিড়। হাঁটতে গেলে গায়ের সঙ্গে গা লেগে যাচ্ছে। ঠিকমতো হাঁটা যায় না। এতটাই ভিড়, গেট দিয়ে বেরুতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রচুর ট্রাফিক সার্জেন্ট ও ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকলেও আদালত চত্বরে কোনোভাবেই যানজট কমছে না।

দেখা গেছে, সিএমএম আদালতের বহুতল ভবনে অনেক সিনিয়র আইনজীবীরা উঠতে পারছেন না। কারণ লিফটে তিল ধারণের জায়গা নেই। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক সিনিয়র ও বয়স্ক আইনজীবী। তারা বলছিলেন, আদালতে প্রচুর মামলার শুনানি হচ্ছে। প্রতিটি আদালতের বিচারকরা পর্যন্ত চরম ব্যস্ততায় সময় পার করছেন।

সরেজমিন সিএমএম আদালতের পশ্চিম দিকে থাকা দুটি লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, লিফট আসামাত্র সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন লোকজন। সিনিয়র আইনজীবীদের পক্ষে রীতিমতো যুদ্ধ করে লিফটে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অনেক সিনিয়র আইনজীবী তাদের জুনিয়র আইনজীবীদের দিয়ে শুনানি করাচ্ছেন। যে কারণে সিনিয়র আইনজীবীদের চেয়ে জুনিয়র আইনজীবীদের তৎপরতা তুলনামূলক অনেক বেশি চোখে পড়েছে। আবার অনেক আইনজীবী একবার ওপরে উঠেছেন তো, আর নামছেন না।

অনেক আইনজীবীর চেম্বারে গিয়ে দেখা গেছে, তারা গাউন খুলে বিশ্রাম করছেন। তারা বলছিলেন, প্রচন্ড ভিড় আর ভ্যাপসা গরমে অনেকেই অসুস্থ বোধ করছেন। রোদ আর গরমের মধ্যে প্রচন্ড গাদাগাদি হওয়ার কারণে আদালত চত্বরে প্রায় সবার অবস্থা কাহিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে