বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

আর কি ওমান যাওয়া হবে পঙ্গু রাকিবের

রেজা মাহমুদ
  ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ২৯ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৭
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাকিব

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার মুদি দোকানদার কবির হোসেইন। তার বড় ছেলে রাকিবের বয়স সবে মাত্র ১৮ ছুঁয়েছে। সারাজীবন যা সঞ্চয় করেছিলেন, তা দিয়েই ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিলেন কবির হোসেইন। চলতি মাসেই পাসপোর্ট করে আবেদন করেছেন ওমানের একটি সেলুনে কাজের ভিসার জন্য। কিন্তু গত শনিবার কোটা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে একটি পা হারিয়ে রাকিব এখন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে।

কি হয়েছিল সেদিন, তা জানতে চাইলে উত্তর দিতে পারেনি রাকিবের বাবা। কেঁদেছেন অঝোরে। রাকিবের অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই, কিছু জিজ্ঞাসা করলে কেবল হঁ্যা-না তেই উত্তর দিতে পারে। এ সময় কথা হয় তার দাদার সঙ্গে। তিনি জানান, অন্যান্য দিনের মতো শনিবারও রাকিব সেলুনের কাজ শিখতে সকালে বাসা থেকে বের হয়। পরিস্থিতি ভালো না, তা যেনেও রাকিব বের হয়। কারণ, দ্রম্নত ভিসা হয়ে গেলে তাকে ওমান যেতে হবে এবং সেখানে গিয়ে সরাসরি কাজে যোগ দিতে হবে। ওমানে কর্মরত তার চাচাত ভাই তাকে এমনটাই জানিয়েছে। তাই ঝুঁকি নিয়েই ওইদিন বাসা থেকে বের হন কাজ শিত।

এরপর কি হলো, এর উত্তর দেন রাকিবের বাবা। তিনি বলেন, 'এই অবস্থার মধ্যে বাইরে না যাওয়ার জন্য বলি রাকিবকে, কিন্তু গলির মধ্যে দোকান সেখানে কোনো সমস্যা হবে না। এ ছড়াও আজকে লোকজন কম, তাই ভালোভাবে কাজ শিখতে পারব। তা না হলে বিদেশ গিয়ে কি করব। এই ছিল ছেলের সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটার আগে শেষ কথা।'

রাকিব যখন বাসা থেকে বের হয় তখন ঢাকা-চিটাগাং রোড রণক্ষেত্র। একপাশে পুলিশ-বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান; অন্য পাশে বিক্ষোভকারীদের। রাবিবের দোকান ঠিক রাস্তার ওপারে। তাই পরিস্থিতি বুঝে যখন গুলির আওয়াজ বন্ধ তখন রাস্তা পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু যখন সড়কের ওপরে ওঠে তখনই গুলির আওয়াজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। যখন দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তখন দেখে তার বাম পা নড়ছে না। একটি বুলেট তার হাঁটু ভেদ করে চলে গেছে। আবার রাস্তায় লুটিয়ে রাকিব।

যারা সেদিন রাকিবকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন, তারা জানিয়েছিলেন, আহত অবস্থা অনেক ক্ষণ পড়েছিল সড়কে। গোলাগুলির কারণে কেউ কাছাকাছি যে পারছিলেন না। ফলে রাকিবকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে অনেকটাই সময় চলে যায়। ততক্ষণে রাকিবের পা থেকে অনেক রক্ত বেড়িয়ে যায়। দুপুরের পর যখন তাকে শ্যামলী পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয় তখন তার পায়ের নিচের অংশ রক্তশূন্য হয়ে সাদা হয়ে যায়। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে চিকিৎসকরা তারা পা কাটার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন রাকিব আগের থেকে কিছু ভালো রয়েছে, কিন্তু তাকে বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে এই পঙ্গুত্ব।

শুধু রাকিব নয়; ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পা হাড়িয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও কয়েকজন। ভর্তি শত শত গুলিবিদ্ধ। তাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, অনেকেরই অবস্থা উন্নতি না হলে হাত অথবা পা কাটা লাগতে পারে। রোববার সরেজমিন হাসপাতালের কেজুয়ালিটি এক ওয়ার্ড ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

\হ

পা হারিয়েছেন মিষ্টির দোকানি আকাশ

রাকিবের মতো পা হাড়িয়ে হাসপাতালের বেডে পড়ে রয়েছেন মো. আকাশ। বাড়ি নেত্রকোনা হলেও কাজ করতেন যাত্রাবাড়ীর একটি মিষ্টির দোকানে। ঘটনার দিন শুক্রবার বিকাল। আকাশ তার দোকান মালিকের সঙ্গে দোকানে এলেন। এর আগে পরিস্থিতি ভালো না থাকায় বৃহস্পতিবার রাতে তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করে গিয়েছিলেন। এদিন এসেছিলেন দোকানের অবস্থা কি তা দেখার জন্য। গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে নিবেন বলে।

কিন্তু ভাগ্য তাদের সঙ্গে ছিল না। হঠাৎ করেই গোলাগুলির তীব্রতা বেড়ে যায়। তাই দোকানেই অবস্থান নেন তারা। অন্যদিকে সড়কে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে চলছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে দোকানের সামইে শুরু হয় গোলাগুলি। আকাশের বাবা মো. দুলাল জানান, তখন পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি এসে পড়তে থাকবে দোকানে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন আকাশ ও তারা দোকানের মালিক। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে যখন তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয় তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক কোনো উপায় না থাকায় পা কাটার সিদ্ধান্ত জানায় আকাশের বাবাকে।

হাসপাতালের ফ্লোরে শুয়ে কাঁদছিলেন তার মা। আকাশের পাসপোর্ট দেখিয়ে বলছিলেন, 'আমার সব টাকা-পয়সা জমা দিয়েছি, আগামী মাসেই আমার ছেলে সৌদি চলে যেত'। এ সময় তার পায়ের এক্সে ছবি দেখিয়ে বললেন, ওরা গুলি করে আমার ছেলেরে পা ঝাঁঝড়া করে দিয়েছে।

বিজিবির গুলিতে পঙ্গু কিশোর রিফাত

এই হাসপাতালে পা হারানো আরেকজন মো. রিফাত। বয়স মাত্র ১৬। এখনো স্কুলের গন্ডি পার হয়নি। থাকে দক্ষিণ বাড্ডার শিমুলতলা এলাকায়। বাবা শ্রমিকলীগের ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রচার সম্পাদক। ঘটনার দিন শুক্রবার সকালে তার বন্ধুর সঙ্গে সে ঘুরতে বের হয়। কৌতুহলবশে যায় প্রধান সড়কে কী হচ্ছে দেখতে।

রিফাত জানায়, 'আমি আর আমার বন্ধু আয়মুন বেলা ১১টার দিকে এসেছিল বাড্ডা-রামপুরা প্রধান সড়কে পরিস্থিতি কি তা দেখার জন্য। যে গলির মাথায় আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, এর কিছুটা দূরে বিজিবির অবস্থান অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা। যখন একটু এগিয়ে সড়কের দিকে যাই তখনই কয়েকটি গুলির শব্দ। দেখলাম একটি গুলি আমার ডান পায়ে লেগেছে। আয়মুনের গায়েও গুলি লেগেছে। কিন্তু ও এখন কেমন আছে জানি না।

রিফাতের বাবা মো. রিয়াজ যায়যায়দিনকে বলেন, 'সেদিন জুমার নামাজের জন্য আমি বের হচ্ছিলাম। এর মধ্যেই খবর আসে রিফাত গুলিবিদ্ধ। আমি আর আমার ছেলেরা সক্রিয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। তা পুরো এলাকা জানে। কিন্তু সেদিন কোনো কারণ ছাড়াই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার ছেলের পায়ে বিজিবি সদস্যরা গুলি করে। পরে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিন্তু ডাক্তার জানালেন, তার পা কাটতে হবে। এরপর সেদিন রাতেই তার পা কাটা হয়।'

এদিকে পা হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন এখানো চিকিৎসারত আরও অনেকই। তেমনি একজন নাসির উদ্দিন। পেশায় একজন ইলেকট্রেশিয়ান। ঘটনার দিন শনিবার রামপুরা এলাকায় দুপুরে খাবারের জন্য বেরিয়েছিলেন, কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে। তার ডান পায়ে গুলি লেগেছে, ডাক্তার বলেছেন আরও দুই দিন অপেক্ষা করবেন। এরপর যদিও পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে পা কাটতে হবে।

তিনি বলেন, 'আমি আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এখন পঙ্গু হয়ে গেলে পুরো পরিবার না খেয়ে মরবে। আমরা ছোট ছোট সন্তানদের কথা ভেবে আমার ঘুম আসে না'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে