দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে হেপাটাইটিসে (লিভারের প্রদাহ) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্বে হেপাটাইটিস 'বি' ও 'সি' ভাইরাসে সংক্রমিত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই জানেন না যে তার শরীরে এই ভাইরাস আছে। ভাইরাল হেপাটাইটিসজনিত কারণে পৃথিবীতে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ৩৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষের হেপাটাইটিস বি ও সি রয়েছে। আর বাংলাদেশে হেপাটাইটিস 'বি' ও 'সি' ভাইরাসে আক্রান্ত এক কোটির বেশি মানুষ। বেসরকারি হিসাবে এই রোগে প্রতি বছর দেশে ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃতু্য হয়। এমন বাস্তবতায় 'এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার' প্রতিপাদ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেপাটাইটিস এখনই নির্ণয় করতে পরীক্ষা করতে হবে। যার শরীরে হেপাটাইটিস নির্ণয় হবে বা পজিটিভ আসবে, তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিতে হবে। আর যাদের নেগেটিভ আসবে-তাদের জন্য 'হেপাটাইটিস বি' প্রতিরোধে নিতে হবে টিকা। 'হেপাটাইটিস সি'-এর কোনো প্রতিরোধক টিকা নেই।
হেপাটাইটিস সাধারণত এ, বি, সি, ডি ও ই-এই পাঁচ ধরনের ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস 'এ' ও 'ই' খাদ্য ও পানীয় জলবাহিত, যা থেকে একুইট (তীব্র) হেপাটাইটিস হয়ে থাকে এবং সাধারণত চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে সেরে যায়। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক লিভার ফেইলিউরও হতে পারে।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও লিভার বিশেষজ্ঞ মোসা. রোকসানা বেগম জানান, হেপাটাইটিস 'বি' ও 'সি' লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ। লিভার ক্যানসারে মানুষের মৃতু্য ক্যানসারজনিত মৃতু্যর তৃতীয় প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। 'হেপাটাইটিস বি' জনিত ৫৪ শতাংশ এবং 'হেপাটাইটিস সি' জনিত ৪৬ শতাংশ লিভার ক্যানসার হয়ে থাকে। নীরবে দীর্ঘদিন ধরে লিভারের ক্ষতিসাধনের জন্য লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার ও লিভার ফেইলিউর হয়ে থাকে- এ জন্য এই দুই ভাইরাসকে 'নীরব ঘাতক'ও বলা হয়।
তথ্য অনুযায়ী, 'হেপাটাইটিস ই' ভাইরাস গর্ভকালীন অবস্থায় গর্ভবতী মা ও সন্তানের জন্য জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। 'হেপাটাইটিস ডি' সাধারণত 'হেপাটাইটিস বি'-এর সঙ্গে তার প্রদাহ ক্রিয়া করে থাকে। কিন্তু প্রধান
উদ্বেগ হচ্ছে হেপাটাইটিস বি ও সি নিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষের হেপাটাইটিস বি ও সি রয়েছে, হেপাটাইটিস বি ২৯ কোটি ৬০ লাখ এবং হেপাটাইটিস সি পাঁচ কোটি ৮০ লাখ, যার জন্য প্রায় ১১ লাখ মানুষ প্রতি বছর মারা যান। ভাইরাল হেপাটাইটিস মানুষের মৃতু্যর দশম কারণ।
শিশুদের ক্ষেত্রে এটির ভয়াবহতা বেশি। আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের অথবা শিশু অবস্থায় আক্রান্ত হলে ৮০-৯০ শতাংশের দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস হয় এবং প্রায় ২০-২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বে মাত্র এক শতাংশ 'হেপাটাইটিস বি' এবং ১.৫ শতাংশ 'হেপাটাইটিস সি' আক্রান্তদের চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৫.৫ শতাংশ 'বি' এবং এক শতাংশেরও কম 'সি'তে আক্রান্ত। গ্রামীণ জনসাধারণের হেপাটাইটিস বি ও সি সম্পর্কে ধারণা অনেক কম। তা ছাড়া সচেতনতা, প্রতিরোধব্যবস্থা, চিকিৎসাও অপ্রতুল। এ ছাড়া ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। জটিল অবস্থায় অথবা শেষ পর্যন্ত রোগ নির্ণয় হওয়া রোগ চিকিৎসার নাগালের বাইরে চলে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে থাকে। এ জন্য এর প্রতিরোধই সমাধান।
লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ হেপাটোলজি সোসাইটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জন্ডিস নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শতকরা ৭৬ ভাগ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস কী? কীভাবে ছড়ায় বা এর চিকিৎসা কী? এসব বিষয়ে গ্রামের মানুষের কোনো ধারণা নেই। রোগ প্রতিরোধে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সাহিদুর রহমান (সহিদ) জানান, দেশে সাড়ে ১৮ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে সরকার। এসব ক্লিনিককে গ্রামীণ বাংলাদেশের 'ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র' হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে হেপাটাইটিস প্রতিরোধের গ্রামীণ অজানা আক্রান্তদের কাছে পৌঁছাতে এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের দোড়গোঁড়ায় পৌঁছানো সহজ হবে।