পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী

এভাবে মায়ের কোল খালি হোক আমি তা চাই না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। এ সময় তাকে আবেগাপস্নুত হতে দেখা যায়

প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সহিংসতায় আহতদের দেখতে যান এবং তাদের খোঁজখবর নেন -স্টার মেইল

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'এভাবে মায়ের কোল খালি হোক, আমি তা চাই না। কারণ, আমি তো বাবা-মা সব হারিয়েছি, আমি তো জানি হারানোর ব্যথা কত কষ্টের। আর সেই ব্যথা বুকে নিয়েই ফিরে এসেছি এ দেশের মানুষের জন্য।' শনিবার সকালে আন্দোলনে আহতদের দেখতে শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন-নিটোরে (পঙ্গু হাসপাতাল) যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে আবেগাপস্নুত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। দেশের উন্নয়নে নিজের ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এখানে আমার তো কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি তো ছেলেমেয়েদের জন্যও কিছু করিনি। শুধু তাদের লেখাপড়া... নিজেরাই চাকরি করে লেখাপড়া করেছে। আমি কতটুকুইবা তাদের জন্য করতে পেরেছি। কিন্তু আমি দেশের মানুষের জন্য করেছি। আজ অন্তত মানুষের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, তাদের কাজের সংস্থান; সবই তো করে দিচ্ছিলাম। যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলাম, তখনই তান্ডব করে ঠিক যে জায়গাগুলো (প্রতিষ্ঠান) মানুষের সেবা করবে, সেই জায়গাগুলোতে আঘাত করা হলো। শিক্ষার্থীরা এখনো আন্দোলন না থামানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও তাদের আর সেই শাটডাউন শেষ হয় না, কী কারণে আমি বুঝি না। আমরা তো সবগুলো দাবিই মেনে নিয়েছি। একটা মানলে আরেকটা, আরেকটা মানলে আরও একটা! আর এর ফল আজকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব একদিকে ছারখার, আর আজকে কত মানুষ জীবন হারাল। কতগুলো মানুষ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। কতগুলো মানুষ...।' ২০০১ সালেও এ রকম তান্ডব বিএনপি-জামায়াত জোট চালিয়েছিল উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগের প্রায় ২১ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করে। কত মানুষ গুলি খেয়ে...তাদের ঘরবাড়ি...হাত-পা কেটে দেওয়া, চোখ তুলে নেওয়া, মেয়েদের রেপ করা- এই তান্ডব ছিল। আবার ২০১৩ সালে অগ্নিসন্ত্রাস। ১৩, ১৪, ১৫ (সালে) আগুন জ্বালানো। বাসের ভেতরে মানুষ, সেখানেও আগুন জ্বালানো। ২০২৩ সালে সেই তান্ডব আর প্রতিবারই পুলিশের ওপর আঘাত। পুলিশকে হত্যা, মানুষ মেরে ঝুলিয়ে রাখা-পুলিশ মেরে ঝুলিয়ে রাখা। গাজীপুরে আমাদের কর্মী মেরে ঝুলিয়ে রাখা। এটা কী ধরনের রাজনীতি আমরা জানি না।' তিনি বলেন, 'যেখানে দাবি করেছে, প্রত্যেকটা দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। মামলা তো তাদের না! আমার করা প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়, সরকারের পক্ষ থেকেই তো আমরা আপিল করি। হাইকোর্টের সেই রায় স্থগিত করে দেওয়া হয়। তাহলে আন্দোলনটা কীসের জন্য ছিল! একেবারে শাটডাউন করে সবাইকে, এরপর মারা। যেসব ঘটনা ঘটেছে, যেভাবে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর যারা মারা গেছে, আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আর যারা এখন আহত, তাদের সবার চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে।' এ সময় চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদও জানান তিনি। তিনি বলেন, 'আহতদের চিকিৎসার জন্য যা যা লাগবে আমরা করে দেব, করে দিচ্ছি। আর যারা পা হারিয়েছে বা হাত হারিয়েছে, আমরা কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দেব, যাতে তারা আবার সুস্থ মানুষের মতো চলতে পারে, নিজের কাজ করতে পারে। এর মধ্যে একজন আবার প্রতিবন্ধীও, কাজেই তার মা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে; প্রতিবন্ধীদের অবশ্য আমরা ভাতাও দিচ্ছি, কিন্তু তাকে আরও ব্যবস্থা করে দেব। আমাদের যতটুকু সাধ্য করে দেব। কিন্তু আমার দেশবাসীর কাছে আমি বিচার চাই। অপরাধটা কী করেছি যে, এভাবে... যেখানে আমি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করেছি।' তিনি বলেন, 'সেই ২০০৮ এর বাংলাদেশ আর ২০২৪-এর বাংলাদেশ তো এক না! বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান তো উন্নত হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি কত উপরে উঠে গিয়েছিল। এটা মনে হলো আর কিছুই না, আমাদের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে বাংলাদেশকে আবার ভিক্ষুকের জাতি করে দেওয়া। এটাই বোধ হয় এদের পেছনে ষড়যন্ত্র। সেটাই হচ্ছে সব থেকে দুঃখজনক। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে যখন একটা জায়গায় নিয়ে আসলাম, আজকে সেখানে দেখি, একদিকে জ্বালাও-পোড়াও সব কিছু। ঠিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সেবা দেয়, আজকে মেট্রোরেলে চড়ে মানুষ কত অল্প সময়ের মধ্যে সময় বাঁচিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছতে পারত, আবার ফিরতে পারত, সেখানে ছাত্ররা-চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষ সবাই তো যেতে পারত। সেই স্টেশনগুলো পুড়িয়ে এখন ট্রাফিক জ্যাম, মানুষের কষ্ট।' সাধারণ মানুষের কাছে নাশকতাকারীদের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি তো কষ্ট লাঘব করেছি, কিন্তু যারা এভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষকে সেই কষ্টে আবার ফেলে দিল, তাদের বিচার এ দেশের মানুষকেই করতে হবে। আমি সবার সহযোগিতা চাই।' শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন। আহতদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবেগাপস্নুত হতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। নিটোর পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী শামীম উজ্জামান আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন। সরকার প্রধানের সঙ্গে এ সময় অন্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মহাখালীতে অবস্থিত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সংশ্লিষ্টরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সরকার প্রধান একইসঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল পস্নাজার ধ্বংসযজ্ঞও পরিদর্শন করেন। জাপানের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এদিকে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন দ্রম্নত চালু করতে জাপানের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এই অনুরোধ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রথমে তারা মেট্রোরেল স্টেশন দুটির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবেন এবং এরপর সিদ্ধান্ত নেবেন, এই মেট্রো স্টেশন দুটি চালু করতে কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা যায়। তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার পেছনে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ জড়িত। যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ এর সুবিধাভোগী। জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, বহু মানুষের ঘাম এবং চোখের জলে এই মেট্রোরেল নির্মিত হয়েছে। কিমিনোরি বলেন, মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর ক্ষয়ক্ষতি দেখে তিনি আহত হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক দেশব্যাপী সংঘাতে হতাহতের ঘটনায় সমবেদনা প্রকাশ করেন ইওয়ামা কিমিনোরি। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ধ্বংসের কথা উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং সেবা দেওয়ার জন্য নির্মিত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান জনগণের জন্য উপকারী আক্রমণকারীরা সেসব প্রতিষ্ঠান টার্গেট করে। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছর নিরলস প্রচেষ্টায় এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, আগস্টের শেষ ভাগে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পাবলিক প্রাইভেট ইকোনমিক সংলাপের জন্য তার দেশের ব্যবসায়ীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সংলাপের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন কিমিনোরি। সৌজন্য সাক্ষাতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ-বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।