সীমান্তরেখা থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ মাইল পর্যন্ত সীমান্ত এলাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সম্পত্তি ঘোষণা করতে জাতীয় সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন দেশটির হাইকোর্ট।
বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা কার্যকরভাবে রক্ষা করতে এমন চার পরামর্শ দিয়ে একটি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। ৩৭ বছর আগের এক মামলা নিষ্পত্তি করে এ রায় দেওয়া হয়।
কেন এই রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট? হাইকোর্টের দেওয়া এই রায়ের তাৎপর্য কী? রায়ের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে কী করতে পারে সরকার? খবর: বিবিসি বাংলা।
মামলার প্রেক্ষাপট : যশোর শহরের ঝুমঝুমপুরে ১৯৮৭ সালের ২ ডিসেম্বর চোরাচালানবিরোধী এক অভিযানে বিডিআর ক্যাম্পের কয়েকজন সদস্য চাঁচরা রায়পাড়া গ্রামের মো. জাকির হোসাইনের বসতঘর থেকে ১৫টি ভারতীয় শাড়ি উদ্ধার করেন।
যার কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি জাকির। পরে কোতোয়ালি থানায় আসামিকে হস্তান্তর করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে এজাহার দায়ের করা হয়।
এ মামলার বিচার শেষে ১৯৮৮ সালের ১৩ এপ্রিল যশোরের বিচারিক আদালত আসামি
জাকিরকে তিন বছরের কারাদন্ড এবং শাড়িগুলো বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেন। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন জাকির।
হাইকোর্টে বিচারপতি আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ গত বছরের ৩ আগস্ট ওই আপিলের শুনানি শেষে আসামিকে খালাস দিয়ে এ রায় দেন। আর গত বৃহস্পতিবার ১১ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
জাতীয় সংসদকে রায়ে দেওয়া চার পরামর্শ
আন্তঃরাষ্ট্র সীমান্ত অপরাধ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা এবং জাতীয় রাজস্ব আয়ে ফাঁকি প্রতিরোধে জাতীয় সংসদকে চারটি পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে দেওয়া এসব পরামর্শের মধ্যে রয়েছে : সীমান্তরেখা থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ১০ মাইল পর্যন্ত সীমান্ত এলাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সম্পত্তি ঘোষণা করা।
ওই ঘোষণার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে সমমূল্যের সরকারি খাস সম্পত্তি বরাদ্দ করা।
সীমান্ত লাইন থেকে ৮ কিলোমিটার ভূমি সম্পূর্ণ ফাঁকা এবং সমান থাকবে। যেন এই ৮ কিলোমিটারের প্রতিটি ইঞ্চি ৮ কিলোমিটার দূর থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
সীমান্তরেখা থেকে ৮-১০ কিলোমিটার মধ্যবর্তী স্থান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের যাবতীয় স্থাপনা, প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় কর্মকান্ডের জন্য সংরক্ষিত রাখা।
রায়ে এসব পরামর্শ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে বলে উলেস্নখ করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে এই রায় ও আদেশের অনুলিপি জাতীয় সংসদের সব সংসদ সদস্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক ও অধস্তন আদালতের সব বিচারককে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ রায়ের তাৎপর্য কী?
এর আগেও বিভিন্ন রায়ে নির্বাহী বিভাগকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আইনজীবীরা বলেন, নির্বাহী বিভাগ কী করবে সেটি পরামর্শ দেওয়া আদালতের দায়িত্ব নয়। সর্বোচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়েও এটি উলেস্নখ করা হয়েছে।
সম্প্রতি গত বৃহস্পতিবারই আরেকটি মামলার এক রায়ে জাতীয় সংসদকে দেওয়া ১৬টি পরামর্শ স্থগিত করেছে আপিল বিভাগ।
দুর্নীতির একটি মামলায় তিতাস গ্যাসের দুইজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দিয়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে রায় দেন বিচারিক আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করলে তাদের খালাস করে ২০২২ সালে রায় দেন হাইকোর্ট।
এই রায়ে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠন করা, বিচারিক আদালতের বিচারক নিয়োগের মতো কর্মকর্তা নিয়োগ করাসহ ১৬টি পরামর্শ দেওয়া হয় জাতীয় সংসদকে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। এই আবেদন মঞ্জুর করেছেন আপিল বিভাগ।
একই সঙ্গে হাইকোর্টের জাতীয় সংসদকে দেওয়া ওই রায়ের পরামর্শ আপিল বিভাগে মামলা দায়ের করার সময় স্থগিত ছিল বলে জানান দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।
একই সঙ্গে এই স্থগিতাদেশের মেয়াদ ফৌজদারি আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
খুরশিদ আলম খান বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত আছে যে জাতীয় সংসদ একটা সেপারেট লেজিসলেটারি ইনডিপেনডেন্ট অরগ্যান। সেক্ষেত্রে জুডিশিয়ারি তাকে কোনো এডভাইস করা বা নির্দেশনা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নাই। এটা সুপ্রিম কোর্টের রায়েই আছে।'
তিনি বলেন, 'সেই রায়ের আলোকেই আমরা দুদকের মামলায় লিভ পেয়েছি এবং সেগুলো স্থগিত করে দিয়েছে।'
নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব কী হবে সেটি সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। ফলে জাতীয় সংসদকে সুপারিশ করা কাম্য নয় বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, 'প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপরে ন্যস্ত এবং এটা সংসদ তার বিবেচনায় করবেন। মানে সংসদ যেমন বিচার বিভাগকে বলতে পারেন না এই মামলায় এই রায় দিতে সুপারিশ করতে পারবে না। একইভাবে বিচার বিভাগও সংসদ কি আইন করবে সেটা সুপারিশ করতে পারবেন না। নির্বাহী বিভাগ দেশের জন্য কোথায় জায়গা লাগবে কী লাগবে না ওইটা নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব।' আদালতের এমন পরামর্শ বাধ্যতামূলক নয় বলেও মনে করেন তিনি।
শাহদীন মালিক বলেন, নির্বাহী বিভাগ বেআইনি কিছু করলে সেটা আদালত অবৈধ বলতে পারেন। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ কী করবে না করবে সেটা সম্পূর্ণ নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার। অতএব নির্বাহী বিভাগকে আদালতের সুপারিশ দেওয়া কাম্য না। সুপারিশ করতে তো কাউকে বাধা দেওয়া যায় না। কিন্তু এটা ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপরে কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না।'
কেন এ রায়?
এ মামলার রায়ে আদালত বলেছেন, বিডিআর ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার ওয়াজেদ আলীর নেতৃত্বে বিডিআরের টহল দলটির যশোর শহরের কাছাকাছি এসে আসামির বসতঘরে তলস্নাশি করার কোনো আইনগত এখতিয়ার আছে কি না এটি এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অর্থাৎ রায়ে তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা চোরাচালানবিরোধী এই অভিযান ওই সীমানায় পরিচালনা করতে পারে কিনা এমন প্রশ্ন বিবেচনায় নিয়েছে হাইকোর্ট।
১৯৭২ সালের 'দ্য বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার' এবং ২০১০ সালের 'বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন' পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট বলেছে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মূল দায়িত্ব হলো বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা এবং আন্তঃরাষ্ট্র সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধ করা।
এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিজিবির সীমান্ত এলাকা কতটুকু এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট। অর্থাৎ সীমান্তরেখা থেকে দেশের ভেতরে কত মাইলের মধ্যে বিজিবির নজরদারির এখতিয়ার থাকবে? ওই দুই আইনেই বিজিবির এখতিয়ারাধীন সীমান্ত এলাকা বলা নেই বলে রায়ে উলেস্নখ করেছে হাইকোর্ট।
'দ্য রেকর্ড অব জুট গ্রোয়ারস (বর্ডার এরিয়াস) অ্যাক্ট, ১৯৭৪' এই আইনটিতে সীমান্ত এলাকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সীমান্ত এলাকার মধ্যে পাট চাষিদের এবং যে জমিতে পাট চাষ করা হয় সেসবের রেকর্ড রাখার জন্য এই আইনটি করা হয়।
এই আইনের একটি ধারা পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়েছে, সীমান্তরেখা থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ১০ মাইল পর্যন্ত এলাকাকে সরকার ১৯৭৪ সালে 'সীমান্ত এলাকা' বা 'বর্ডার এরিয়া' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
রায়ে বলা হয়েছে, 'সুতরাং এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশ রাইফেলস বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কার্যপরিধি তথা এখতিয়ারাধীন এলাকা সীমান্তরেখা থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ মাইল।'
ফলে বিডিআর সদস্যরা সীমান্ত এলাকা অর্থাৎ ১০ মাইল সীমানার বাইরে যেয়ে যশোর শহরের কাছাকাছি ওই তলস্নাশি অভিযান পরিচালনা করেছে। তাই ওই অভিযান এবং মামলা দুটিই এখতিয়ারবিহীন বলে রায়ে বলা হয়েছে।
রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
এই মামলা এবং হাইকোর্টের রায়টি পুরো পর্যালোচনা করে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন।
তিনি দুদকের মামলাটির উদাহরণ টেনে জানান, জাতীয় সংসদকে বিচার বিভাগ সুপারিশ করতে পারে না।
আমিন উদ্দিন বলেন, 'জাতীয় সংসদকে সুপারিশ করতে পারে না বিচার বিভাগ এই গ্রাউন্ডেই ওই মামলায় আপিল করার অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ। কারণ প্রত্যেকে যার যার অধিক্ষেত্রে স্বাধীন, প্রত্যেকেই নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এটা আইনেই আছে।' জাতীয় সংসদের জন্য এ রায়টি বাধ্যতামূলক নয় বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি বলেন, 'সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেকের সীমারেখা আছে। কে কী করতে পারবে এটা বলা আছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা স্বাধীন। অন্য কারও পরামর্শ তাদের জন্য প্রযোজ্য না। জাতীয় সংসদের প্রতি এ রায়টি বাধ্যতামূলক না।'