কী হবে আজ? সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির পর কি দেশব্যাপী যে হানাহানি-রক্তপাতের ঘটনা ঘটে চলেছে তার অবসান হবে? কী হবে সরকারি চাকরির কোটা নিয়ে? না-কি পরিস্থিতি মোড় নেবে ভিন্ন দিকে? এমনই নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে উৎকণ্ঠিত দেশবাসী তাকিয়ে আছে আজ অনুষ্ঠেয় চেম্বার আদালতে আপিল শুনানির দিকে।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত) কোটাপদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরিপত্রে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করা হয়।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। গত ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।
আপিল বিভাগের আদেশের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আদালতের সঙ্গে আমাদের আজকের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা মূলত নির্বাহী বিভাগের কাছেই কোটা-সমস্যার
চূড়ান্ত সমাধান চাইছি। এক দফা দাবি। এটি আদালতের এখতিয়ার নয়। এটি একমাত্র নির্বাহী বিভাগই পূরণ করতে পারবে। সরকারের কাছ থেকেই আমরা সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করছি।'
হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা। ১ জুলাই থেকে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ব্যানারে তারা কোটা বাতিলসহ চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন।
এর অংশ হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে তারা 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি পালন করেন। তাদের অবরোধের কারণে শহরজুড়ে ব্যাপক যানজটে নাকাল হতে হয় নাগরিকদের। পরে চার দফা দাবিকে এক দফায় নামিয়ে আনেন। তারা দাবি করেন- সব গ্রেডে সব ধরনের 'অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক' কোটা বাতিল করে সংবিধানে উলিস্নখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে 'নূ্যনতম পর্যায়ে' এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে।
এই দাবিতে সারাদেশে বাংলা বস্নকেড কর্মসূচির ঘোষণা আসে। তাদের এই আন্দোলনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোটা নিয়ে স্থিতাবস্থা জারির আদেশ আসে। তবে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, 'আইন করে কোটা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত' তাদের আন্দোলন চলবে।
এর পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন চাকরি প্রত্যাশী তরুণরা। কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে কয়েকদিনে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ। 'বাংলা বস্নকেড' নামে অবরোধ এবং 'কমপিস্নট শাটডাউন' নামে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির তিন দিনে দফায় দফায় সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। শিক্ষার্থী, জনতা, সাংবাদিক-পুলিশসহ নিহত হয়েছেন শতাধিক। বহু স্থানে ও স্থাপনায় দেওয়া হয়েছে আগুন। এতে ভস্মীভূত হয়েছে রাষ্ট্রীয় বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। পোড়ানো হয়েছে সরকারি যানবাহন, আগুনে পুড়েছে গুরুত্বপূর্ণ নথি। বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট সেবা। সারাদেশের সঙ্গে প্রকারান্তরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকা। বাতিল করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্বনির্ধারিত স্পেন সফর কর্মসূচি। এরই মধ্যে শুক্রবার রাতে জননিরাপত্তায় সারাদেশে জারি করা হয়েছে কাউফিউ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অজানা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। দেশের সাধারণ মানুষও আতঙ্কিত।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। প্রকাশিত হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে বলা হয়, কোটা বাতিল করা হলেও সরকার নির্বাহী বিভাগ ইচ্ছা করলে তা পরিবর্তিত বা পরিমার্জিত করতে পারবেন।
এদিকে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে সরকার যে আপিল করে তার ৭ আগস্ট এই শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে কোটা বিরোধীদের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে পড়ে দেশ। নানা কর্মসূচি পালনের পর আন্দোলনকারীরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ ডেকে তাদের স্বপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আইন পাস করার আহ্বান জানান।
এ পর্যায়ে চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অংশ বিশেষ এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য নিয়ে সৃষ্ট ঘটনার প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় সারাদেশে কোটার আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। এতে ঝরে যায় শতাধিক প্রাণ।
এদিকে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সমর্থন দেয় বিএনপিসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে 'অযৌক্তিক' উলেস্নখ করে অভিযোগ তোলা হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী নাশকতার পরিকল্পনা করছে বিএনপিসহ একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গত বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। একই সঙ্গে তারা এ ব্যাপারে সরকারের আলোচনার জন্য কথাও বলবেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঘোষণা দিতে বলেছেন যে, আগামী ৭ আগস্ট যে মামলাটি শুনানির কথা ছিল, সেই মামলার শুনানি এগিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে। আমি সে মর্মে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছি যে, আগামী রোববার তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে আবেদন করবেন, যাতে মামলাটির শুনানির তারিখ তারা এগিয়ে আনেন।'
এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল এম এ আমিন উদ্দিন বলেন, 'কোটা বাতিল চেয়ে লিভ টু আপিল দ্রম্নত শুনানি করতে সরকারের পক্ষ থেকে আমার প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা রোববার সকালেই আপিল বিভাগে লিভ টু আপিলের জন্য মেনশন করব। ইতোমধ্যে শুনানির সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলেও আন্দোলনকারীরা আলোচনায় বসতে সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ডাকা এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আপিলে সরকারের পক্ষ থেকে ৮০ শতাংশ মেধা কোটার প্রস্তাব দেওয়া হবে। এরপর এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না বলে আশা করা হয়।
এরপর দ্রম্নত পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। দেশব্যাপী সহিংস ঘটনায় শতাধিক প্রাণহানির পর সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানান শিক্ষার্থীরা। তারা এখন আট দফা দাবি তুলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি মানা হলে তারা আলোচনায় বসবেন বলে জানিয়েছেন। এরই মধ্যে আপিল বিভাগে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে আজ।