রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

মাথায় গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন মুগ্ধ, প্রিয় ও রিয়াদ প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

বিবিসি বাংলা
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মুগ্ধ, প্রিয় ও রিয়াদ

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যখন লুটিয়ে পড়ছিলেন তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। গত ১৮ জুলাই মুগ্ধর রক্তে যখন রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল, তখন তার বন্ধুরা বহু সংগ্রাম করেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি।

মুগ্ধর বন্ধু আশিক এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, 'অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছিল কিছুক্ষণ পর রিকশায় করে মুগ্ধকে নিকটস্থ ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।'

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র মুগ্ধ বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকার উত্তরা এলাকায়। তার বাসাও সেখানে। যেদিন মুগ্ধ মারা যান, সেদিন রাজধানী ঢাকা ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। সংঘাত ছড়িয়েছিল শহরের অলিগলিতে।

বিক্ষোভে নিহত বহু মানুষের তো মুগ্ধর সদা হাস্যোজ্জ্বল ছবি এখন ফেসবুকে ছড়িয়েছে। অন্যান্য অনেকের মতো মুগ্ধর বন্ধু-পরিজনও গত কয়েকদিন ধরে তাকে নিয়ে ফেসবুকে স্মৃতিচারণা করছেন।

মুগ্ধ যখন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তখন তার কাছাকাছি ছিলেন বন্ধু জাকিরুল ইসলাম। মুগ্ধর কপালে গুলি লাগার দৃশ্যকে তিনি এভাবে বর্ণনা করেন, 'গুলি লাগছিল কপালে, মেয়েরা যেখানে টিপ পরে-ডান কানের পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে।'

মুগ্ধর বন্ধু জাকির শুক্রবার বলেন, 'গুলি লাগার পর ওর মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছিল। ঘটনাস্থলে আমাদের চোখের সামনেই ও মারা গেল। মুগ্ধ সবাইরে পানি খাওয়াইতেছিল। আমাদের কাছে না ছিল কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, না ছিল অন্য কোনোকিছু। তারপরও এভাবে আমার বন্ধুরে গুলি করে মাইরা ফেলাইলি? আমার সামনে ঘটে যাওয়া এ সিন আমি কিভাবে ভুলি?'

মুগ্ধর রক্তে ভেসে যাওয়া সেই রাস্তার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন মুগ্ধরই আরেক বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। তিনিও সেদিন মুগ্ধর মৃতু্যর সাক্ষী হয়েছেন।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে আশিক লিখেছেন যে তিনি, মুগ্ধ ও তাদের বন্ধু জাকির আন্দোলনের মধ্যেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রোড ডিভাইডারের ওপর বসেছিলেন। তিনি আরও বলেন, 'হঠাৎ সবাই আমির কমপেস্নক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ে আসছে! আমরা দেখলাম! কিছুটা ধীরগতিতেই উঠব ভাবলাম! দুই-তিন সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের ওপরে হাত রেখে বললাম- চল দৌড় দেই। আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বলল-চল!'

তার বর্ণনা অনুযায়ী প্রথমে জাকির উঠে দৌড় দিলেন এবং তারপর তিনি। কিন্তু তিন থেকে চার কদম যাওয়ার পর তার সামনেই জাকিরকে দেখছেন দৌড়াচ্ছে। কিন্তু তার পাশে মুগ্ধ নেই!

তিনি আরও বলেন, 'থেমে গেলাম, পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলাম-জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইছে!'

কক্সবাজারে যায়নি মুগ্ধ

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মুগ্ধর বড়ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত জানান, ১৮ জুলাই সকালে তারা সপরিবারে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। কিন্তু মুগ্ধ ও তাদের ছোটভাই স্নিগ্ধ কক্সবাজার যায়নি। কারণ ভ্রমণপিপাসু মুগ্ধ চেয়েছিলেন, তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে ২০ জুলাই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ঘুরতে যাবেন। তবে ঘুরতে যাওয়ার আগে মুগ্ধ কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিজে তো অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন যে তার যমজ ভাই স্নিগ্ধও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করুক।

তিনি আরও বলেন, 'দুইদিন আগেও আবু্বর সঙ্গে এ নিয়ে ওর কথা হচ্ছিল। আবু্ব তখন বলছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারের জন্য কথা বলতেছে। সেখানে তুমি সাহায্য করার জন্য যাইতেও পার। সেজন্য ও ডিরেক্টলি আন্দোলনে যায়নি।'

তিনি জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ তিনি মুগ্ধর মৃতু্যর খবর পান এবং তারপর সপরিবারে ওইদিনই ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। কারণ ওইদিন সন্ধ্যার পর কোনো ফ্লাইট ছিল না। আর সড়কপথে এলেও অনেকটা সময়-ধকল হয়ে যেত। পরে তারা পরদিন ভোরের ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন।

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি গত মার্চে ভর্তি হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস বা বিইউপিতে।

'পাঁচদিন পর জানতে পারলাম- প্রিয় আর নাই'

দেশজুড়ে চলমান কারফিউর মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ২০ জুলাই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়।

তার বন্ধুরা বলছেন, মৃতু্যর পর তার লাশ সড়কেই পড়ে ছিল। কেউ হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। বরং পরে তার লাশের সন্ধান মেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে।

ফারিয়া উলফাত সৈয়দ নামক একজন লিখেছেন যে ঢাকার গ্রিন রোডের ল্যাবএইডের পেছনে বিকাল পাঁচটার দিকে তিনি তাহির জামান প্রিয়কে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন।

তারা একসঙ্গেই ঘটনাস্থলে ছিলেন উলেস্নখ করে তিনি লেখেন, ল্যাবএইডের পেছনে পুলিশের ঘেরাও করে রাখা একটি রাস্তায় একজন মানুষ একটা বডি টেনে সেন্ট্রাল রোডে আনার চেষ্টা করছে। আর, হাত দিয়ে ডাকছে-উনাকে হেল্প করতে। তিনি সবার পেছনে থাকায় দেখতে পান।

তিনি বলেন, 'সাহস করে উনাকে হেল্প করতে একটু কাছে যেতেই দেখি মানুষটার মাথার পেছনজুড়ে রক্ত, নিথর দেহ, মানুষটা প্রিয় ভাই দুই মিনিট আগে আমাকে যে একসঙ্গে থাকতে বলল।'

তিনি আরও লেখেন, 'ভাইয়ার কাছাকাছি যেতেই আবার ফায়ারিং হলো, আর আমি এবার সত্যিকারের দৌড় দিলাম। দৌড়ানোর সময় তাকালাম পিছে, রাস্তায় ভাইয়া পড়ে আছে, একলা। কিন্তু আনতে পারলাম না। ভাইয়ার লাশ কই আছে, খুঁজতে খুঁজতে ওইদিন রাত ১২টা-১টা বেজেছে।'

কিন্তু তাহির জামান প্রিয় যখন মারা যান, তখন দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। ফলে সারাদেশের মানুষ একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তার অনেক বন্ধুরা তার মৃতু্যর খবর পাননি, শেষ বিদায় জানাতে পারেনি।

গত বুধবার থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ কিছুটা চালু হলে এক সময়ের কাছের বন্ধু 'প্রিয়'র মৃতু্যর খবর জানতে পারেন মেহেরুন নাহার মেঘলা। তিনি আফসোস করে বলেন, 'আজ পাঁচদিন পর জানতে পারলাম প্রিয় আর নাই। ওরা তিনজন ছিল। একজনের হাত ঘেঁষে ওর মাথায় গিয়ে গুলি লাগছে। লাশটা পড়ে ছিল। গোলাগুলির মধ্যে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। দুইদিন পর পরিবার লাশ নিতে পারছে।'

প্রিয়র চার বছর বসয়ি একটা কন্যাসন্তান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'বাচ্চাটাকে মাত্র একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করছিল। বাচ্চাটার মা থেকেও নেই। প্রিয়ই ওর বাবা-মা ছিল।'

'আমার বন্ধু শিবির না'

প্রিয়র মৃতু্যর দুদিন আগে ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের (ডিআরএমসি) ছাত্র ফারহান ফাইয়াজও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিহত হন।

বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ফাইয়াজের বন্ধুদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফাইয়াজকে সিটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।

ডিআরএমসির আরেক শিক্ষার্থী ফাইয়াজের বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমরা একই জায়গায় আন্দোলন করছিলাম। আমি কাছাকাছিই ছিলাম। হঠাৎ শুনি ওর গুলি লাগছে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বুলেটও বের করে নাই...অনেকে বলছে রাবার বুলেট ছিল।'

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ফাইয়াজের মৃতু্যর পর তার জানাজা নিয়ে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ ডিআরএমসি কর্তৃপক্ষ তার জানাজার অনুমতি দিতে চাচ্ছিল না।

ফাইয়াজের বন্ধু বলেন, 'অথরিটি চায়নি যে ক্যাম্পাসে ওর জানাজা হোক, তাদের ওপর উপরমহলের চাপ ছিল হয়তো।'

দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি

টঙ্গী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ, যিনি গত ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

তার বোন শিমু আহমেদ লেখেন, 'আমার ভাইকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের হাসিখুশি পরিবার এক সেকেন্ডে শেষ।'

ফেসবুক পোস্টে তিনি আরও লেখেন, 'একটা দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সত্যি এটা যে আমার একমাত্র ছোটভাই, আমার আম্মুর জান আর নাই।'

রিয়াদের বন্ধু তাসনিম জামান বন্ধুকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, 'আজকে নিয়ে ছয় দিন হতে চলল, তুই নাই। এখনো বিশ্বাস করি না যে তুই আর আমাদের মধ্যে নাই। তুই কোনোদিনই আর ফিরে আসবি না।'

শুধু প্রিয়, ফাইয়াজ কিংবা রিয়াদ না, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ শিক্ষার্থী, কেউ সাংবাদিক, কেউ কেবলই সাধারণ মানুষ এবং এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে