রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে খুঁজে অপরাধীদের বের করুন

আহতদের চিকিৎসা-আয়ের ব্যবস্থা করবে সরকার শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন (বিটিভি) পরিদর্শন করেন -ফোকাস বাংলা

বিএনপি-জামায়াত ও শিবির দেশের উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই দেশব্যাপী তান্ডব চালিয়েছে বলে উলেস্নখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, 'যারা এসবের সঙ্গে জড়িত, সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যে যেখানে আছে, তাদের খুঁজে বের করুন। তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য সহযোগিতা করুন। আমি দেশবাসীর কাছে এই আহ্বান জানাচ্ছি।'

শুক্রবার সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে রামপুরার বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে (বিটিভি) চালানো ধ্বংসযজ্ঞ পরিদর্শন শেষে দেশবাসীর প্রতি এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংসের প্রসঙ্গ উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'তবে এবারের আগুন লাগানোর ধরন আগেরগুলোর তুলনায় আলাদা। তারা এবার আগুন লাগাতে গানপাউডার ব্যবহার করেছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিন্তু টেলিভিশনের ওপর হাত দেয়নি বা কেউই কখনো হাত দেয়নি। কিন্তু আজকে এই টেলিভিশন সেন্টারকে যারা এভাবে পোড়াল, একটা কিছু নেই যে তাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাহলে এরা কারা? এরা কি এ দেশেরই মানুষ? এদের কি এই দেশেই জন্ম? একটা দেশকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার চিন্তা নিয়েই যেন তাদের এই আক্রমণ।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মেট্রোরেল যেটা ছিল সারা বিশ্বের প্রতিটি বাঙালির কাছে একটা সম্পদ, সেটাকে ধ্বংস করল। যার মাধ্যমে মানুষ অল্প সময়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারত। আজ সেটা বন্ধ। আবার সেই ট্রাফিক জ্যাম, আবার সেই পূর্বের অবস্থায় মানুষকে ফেলে দিল। আর এই টেলিভিশন সেন্টারে তারা যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যেসব জিনিস মানুষের সেবা করে মানুষের জন্য কাজ করে, সেই জায়গাগুলোতেই আঘাত।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও আগুন দিয়ে পোড়াল। গাড়িগুলো, এমনকি জাপান থেকে আনা সিটি করপোরেশনের অত্যাধুনিক ময়লার গাড়িগুলো পুড়িয়েছে, পানি শোধনাগারে হামলা করতে গেছে, পয়ঃশোধনাগারে হামলা, এটা কী হচ্ছে? কী তাদের মানসিকতা? আমি তাই দেশবাসীকে বলব, এই ঢাকাবাসীকেই বলব, আজ আপনাদের এই দুর্ভোগ, আমি তো লাঘব করে দিয়েছিলাম। কিন্তু যারা এটা ধ্বংস করল, আর যাদের জন্য এই দুর্ভোগ, আর যাদের জন্য আজ বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, আমি তাদের বিচারের ভার এ দেশের জনগণের ওপরই দিয়ে যাচ্ছি।'

তিনি বলেন, 'যারা এ দেশের মানুষের রুটি-রুজির ওপর হাত দিয়েছে, রুটি-রুজির পথ বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের বিচার জনগণকেই করতে হবে। কারণ, এ দেশের জনগণই একমাত্র শক্তি।'

শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি

আমার বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করা হয়েছিল উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের দিকেই যেন তাদের বেশি ক্ষোভ। আমার একটা কথা নিয়ে কতদিন প্রতিবাদ করল, কী কথা বলেছিলাম আমি? আমার কথাটাকে বিকৃত করা হয়েছিল। তাদের সেস্নাগানটা কী? 'তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। তোমার বাবা, আমার বাবা- রাজাকার রাজাকার।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'তার মানে তারা নিজেদেরকেই রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিল। আমি তো তাদের রাজাকার বলিনি, তারা নিজেরাই সেস্নাগান দিয়ে নিজেদেরকে রাজাকার হিসেবে পরিচিত করল সকলের কাছে।'

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে গত ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধান বলেন, 'কোটা আন্দোলন করার আগে তো তাদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যে- কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা (চাকরি) পাবে? মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে, নিজের পরিবার সংসার সব বাদ দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, খেয়ে না খেয়ে, কাদা মাটিতে রোদ বৃষ্টি ঝড় সব উপেক্ষা করে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে।'

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, 'বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে কাউকে যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে। আসল সত্যটা জানুন।'

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, 'এই দেশ আমরা অনেক কষ্ট করে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে স্বাধীন করেছি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। সেই মর্যাদাকে ধ্বংস করার জন্যই এই ধ্বংসযজ্ঞ।'

শেখ হাসিনা বিটিভির ধ্বংসযজ্ঞ আর পোড়া অবস্থা দেখে স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, 'আজ অতীতের কথা মনে পড়ে, আমি কতবার এখানে এসেছি। প্রত্যেক নির্বাচনের আগে এখানে ভাষণ দিতে এসেছি। নানা অনুষ্ঠানে এসেছি। আজ যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখলাম, এরপর এটা আবার কবে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে, জানি না।'

বিটিভির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আপনারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেক চেষ্টা করেছেন। এই সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে পার পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। তবু আপনারা এই জাতীয় সম্পদকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন।'

প্রধানমন্ত্রী এ সময় অত্যন্ত আবেগাপস্নুত কণ্ঠে বলেন, 'এগুলো দেখে আমি আসলে আর কথা বলতে পারছি না। এক একটা জিনিস গড়ে তুলতে অনেক কষ্ট করতে হয়।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'দেশের জনগণের উন্নয়নের জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করি। সেটা আমার দেশের মানুষেরই জন্য। একটা জিনিস এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করি, যাতে এগুলো শুধু দেশে নয়, বিদেশিদের কাছেও দৃষ্টিনন্দন হয়। আমরা দেশের যে উন্নতি করছি, তার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই জায়গাগুলো একে একে ধ্বংস করা হচ্ছে। এত দিনের কষ্টের ফসল সব শেষ করে দিতে চাচ্ছে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কষ্টের। দেশবাসীর কাছে এর বিচার চাই, আমি তাদের সহযোগিতা চাই।'

বিটিভির সদর দপ্তর ও ভবনে ভাঙচুরের একটি ভিডিও চিত্রও প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হয়।

বিটিভির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তান্ডবলীলায় বিটিভির বিভিন্ন অবকাঠামো, সম্প্রচার সরঞ্জাম, নকশা বিভাগ, অফিস ভবন ও বিভিন্ন কক্ষ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

সন্ত্রাসীদের তান্ডবলীলায় ১৯৬৪ সাল থেকে সংরক্ষিত অমূল্য প্রাচীন জিনিস দিয়ে সজ্জিত টেলিভিশন জাদুঘর এবং মুজিব কর্নার, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, প্রায় ৪০টি কম্পিউটার, ১০০টি টেলিভিশন সেট এবং কম্পিউটার ল্যাবের আসবাব, প্রশিক্ষণ কক্ষ ও প্রিভিউ রুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনটি তলায় আগুন দিয়ে পোড়ানো এবং যন্ত্রাংশ লুটপাট, ১টি সম্প্রচার ওবি ভ্যান, ১৭টি গাড়ি ও ২১টি মোটর সাইকেলে আগুন এবং ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করাসহ সম্পূর্ণ স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে।

আহতদের চিকিৎসা-আয়ের ব্যবস্থা করা হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকালে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) যান। ঢামেকের কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজখবর নেন। তিনি চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলেন। আহতদের সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

এ সময় 'দলমত নির্বিশেষে আহত সবার চিকিৎসা ও আয়-রোজগারের ব্যবস্থা সরকার করবে' জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসার জন্য যা যা দরকার সবই করবে সরকার। আহতরা যেই দলেরই হোক চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার।'

শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, 'কোটা নিয়ে সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও কেন আন্দোলন শেষ হচ্ছে না?'

এ সময় বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা-বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে