রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ

আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে ছিলেন না দলের নেতাকর্মীরা :সাংগঠনিক এই দুর্বলতা কাটাতে গোটা দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসী ও নাশকতা মোকাবিলায় রাজপথে দেখা মেলেনি আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের নাজুক অবস্থান ছিল দৃশ্যমান। আন্দোলন মোকাবিলার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে না থাকাসহ প্রশ্নবিদ্ধ ঢাকা মহানগরের এমপিদের ভূমিকাও। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই এখন কাঠগড়ায়।

ফলে সন্ত্রাসীরা অনেকটা নির্বিঘ্নে বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, ডাটা সেন্টার, মেট্রোরেলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করতে পেরেছে। হামলা করেছে পুলিশের ওপরও। নাশকতাকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের মোকাবিলায় বেশ বেগ পেতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তবে রমনা, পল্টন, মতিঝিল, খিলগাঁও, সবুজবাগ, আদাবর, ওয়ারী ও সূত্রাপুর এলাকায় প্রশাসনের পাশাপাশি লাঠিসোটা হাতে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে দেখা গেছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের। কিন্তু গা ঢাকা দিয়েছিল বেশির ভাগ নেতা। এত বড় ঘটনায় ঢাকার দলীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি বড় ধরনের সাংগঠনিক দুর্বলতা হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দলের হাইকমান্ড। মহানগরীর সাংগঠনিক এই দুর্বলতা দূর করে আওয়ামী লীগের সুপার এই ইউনিটটির মূল দলসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করবে দলটি। পাশাপাশি যেসব নেতা এই সংকটে গা-ঢাকা দিয়েছিল, তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে হাইকমান্ড।

এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নানা দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে বলে স্বীকার করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এই ঘটনায় ছাত্রলীগের ওপর ক্ষোভও ঝাড়েন তিনি। বলেন, 'ছাত্রলীগ ফাঁপা বেলুনের মতো চুপসে গেছে, রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে'।

এদিকে এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন এই ঘটনায় দলের দুর্বলতাগুলো সামনে এসেছে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় নেতাদের কমিটিতে স্থান না পাওয়া, নিয়মিত সম্মেলন না হওয়া, নেতৃত্ব নির্বাচনে অর্থের ব্যবহার ও নেতাদের পরিবারের লোকজন প্রাধান্য পাওয়ায় তৃণমূলে দলের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এত ভয়াবহ হয়ে ওঠার পেছেনেও নেতাদের বেশি দায়ী মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দলের শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘ রাজনীতির অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বে তারা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা আঁচ করতে পারেননি। এছাড়াও প্রশ্ন তুলেছেন সারাদেশে ঘোষিত আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোর মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা নিয়েও।

আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন, বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রীয় নেতা থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা অনেকাংশে দায়ী। ত্যাগী নেতাকর্মীদের জায়গা না দিয়ে হাইব্রিডদের জায়গা করে দিয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কমিটিতে পদায়ন করেছেন। নামমাত্র সম্মেলন করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি দিয়েছেন। তার ফল এখন দৃশ্যমান হয়েছে।

এদিকে ঢাকা মহানগরের মতো শাখায় যুবলীগের কমিটি নেই, সম্মেলন হয় না এক দশকের বেশি। ফলে এই যুব সংগঠনের তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই, সারাদেশে কিছু সম্মেলন দিয়ে কমিটি করা হলেও নতুন কমিটি হয়নি বেশির ভাগ জায়গায়।

ইতোমধ্যেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে সন্ত্রাস-সহিংসতা প্রতিরোধে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে না থাকার অভিযোগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তত ২৭টি ইউনিট কমিটি। শুধু মহানগর নয়, সারাদেশে আওয়ামী নেতাকর্মীদের ভূমিকা নিয়ে চলছে দলের হাইকমান্ডে বিস্তর আলোচনা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা-১৩ আসনের তিনটি থানা ও আটটি ওয়ার্ড নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে আওয়ামী লীগ। এই সভা থেকে এসব কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিকাল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ও ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক রানা এবং থানা-ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ২৭টি ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা সন্ত্রাস-সহিংসতা মোকাবিলায় সরাসরি অংশ নেননি বলে অভিযোগ ওঠে। এজন্য এসব ইউনিট কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে শেখ বজলুর রহমান জানিয়েছেন, ঢাকা-১৩ সংসদীয় আসনের অন্তর্গত আটটি ওয়ার্ডের ১২৬টি ইউনিট কমিটির মধ্যে অনেকগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে ঠিক কতটি কমিটি ভাঙা হয়েছে, সেটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না।

এছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা ও নৈরাজ্যে প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের মহানগরের শীর্ষ নেতাদের বিশেষ করে এমপিদের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে তড়িঘড়ি করে বৈঠক শেষ করতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

জানা গেছে ঢাকা-১৪ আসনের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিল তার এলাকায় সন্ত্রাস-সহিংসতা প্রতিরোধে দলের কোনো নেতাকে পাশে পাননি বলে অভিযোগ করেন। কয়েকজন নেতার নামও উলেস্নখ করেন তিনি। তার এ কথায় ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক মান্নান কচি জোরালো প্রতিবাদ জানালে দুই নেতার মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়। কচি এক পর্যায়ে নিখিলকে 'বেয়াদব' আখ্যা দিয়ে 'মাস্তানের মতো আচরণ না করার' জন্য বলেন।

এছাড়াও ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের নেতৃত্বে স্থানীয় নেতারা সহিংসতা প্রতিরোধে মাঠে তৎপর ছিলেন না বলেও অভিযোগ ওঠে। তাদের বক্তব্য ছিল, সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং হামলা-ভাঙচুর মোকাবিলায় কামাল মজুমদারকে পাশে পাওয়া যায়নি। অনেক নেতা ঘর থেকে বের হননি। এ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মাইক নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে চলাকালে মিরপুর, পলস্নবী ও কাফরুলের কয়েকটি এলাকায় তীব্র সহিংসতার ঘটনা ঘটে। মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু তাদের প্রতিহত করতে আওয়মী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যর্থ হন। যদিও এসব এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে ব্যানার টানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।

দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, 'দুর্বলতা আছে অস্বীকার করার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য এসেছে। তাদের মধ্যে আন্দোলন করার চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি অনেকে অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করার সাহসও হারিয়েছেন। তবে দুর্বল থেকে সবল করার উপায়ও আছে। সেই পথে আওয়ামী লীগ হাঁটছে।'

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সহিংস পরিস্থিতিতে এমপিরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, সমন্বয় ছিল না স্থানীয় নেতা ও কর্মীদের মধ্যে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুর এলাকায় দলের দুর্বলতা স্পষ্ট। এমনকি এই মুহূর্তে মহানগরের কমিটি দিলে নিজেদের মধ্যেই আগুন জ্বলবে বলেও আশঙ্কা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে