বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

স্বস্তি ফিরলেও ভয় কাটেনি

যানজটের পুরনো রূপে রাজধানী স্বাভাবিক হয়ে আসছে জনজীবন ইন্টারনেট চালু হওয়ায় ফিরেছে ভার্চুয়াল জগতের গতি রেল যোগাযোগ আপাতত বন্ধ
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
স্বস্তি ফিরলেও ভয় কাটেনি

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক নাশকতা ও তান্ডব পুরোপুরি থেমে যাওয়ায় সারাদেশে কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানো হয়েছে। এতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে জনজীবন। মানুষের চলাচল ও কাজে অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিভিন্ন গন্তব্যে দূরপালস্নার বাস ছাড়তে শুরু করেছে। বাজার-হাট, দোকানপাট ও অফিস-আদালতে কারফিউ শিথিলের সময় স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। ইন্টারনেট সেবা চালু হওয়ায় ফিরেছে ভার্চুয়াল যোগাযোগের গতি। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, শিল্প-কারখানা ও ব্যাংক-বীমা খাতের স্থবিরতা দূর হওয়ায় অর্থনৈতিক মন্দাও কাটতে শুরু করেছে।

তবে সারাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরলেও ভয় এখনো কাটেনি। নগরবাসী জানিয়েছেন, পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় টানা কয়েকদিন আটকে থাকার পর সুযোগ পেয়ে সবাই জরুরি কাজ সেরে নিচ্ছেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজে-কর্মে কিংবা বেড়াতে এসে আটকেপড়া মানুষ দ্রম্নত নিজ গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেননা, অনেকেরই শঙ্কা, সেনাবাহিনী ও কারফিউ তুলে নেওয়ার পর পরিস্থিতি আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ফের তান্ডবে নামতে পারে দুষ্কৃতকারীরা। কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ঢাল বানিয়ে বিশেষ গোষ্ঠী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আবারও সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।

একই ধরনের ভয় নিয়ে উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। তাদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায়

সাধারণ মানুষ জরুরি কাজ সেরে নিতে একযোগে রাস্তাঘাটে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। এ কারণে গোটা ঢাকা এখন যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা থেকে কারফিউ শিথিল থাকলেও এরপরও নগরবাসীকে যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। তবে এভাবে গণপরিবহণ কতদিন রাস্তায় চলতে পারবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মালিক-শ্রমিকরা। তাদের শঙ্কা, কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ফের ঢাকাসহ সারাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আবারও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পরিবহণ ব্যবসায় ধস নামবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মালিকরা।

এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেওর্ যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সতর্ক রাখা হচ্ছে। সেনা বাহিনী ও বিজিবির টহল আগের মতোই জোরদার রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যে কোনো ধরনের নাশকতা ও সহিংসতার ষড়যন্ত্রের আগাম তথ্য সংগ্রহে ডিবি, এসবি ও এনএসআইসহ সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে।

শুক্রবার জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমসহ ঢাকার কোনো মসজিদ থেকে যাতে বিক্ষোভ মিছিল বের হতে না পারে সে ব্যাপারের্ যাব-পুলিশকে সতর্ক রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আগাম তথ্য সংগ্রহে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের যেসব মাদ্রাসা থেকে বিভিন্ন সময় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা ঘটানো হয়েছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সেখানকার শিক্ষকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

সরকারের নীতি-নির্ধারকদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হলেও যে কোনো মুহূর্তে দেশ ফের অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। কোটা আন্দোলনকে নতুন আঙ্গিকে চাঙ্গা করে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারী চক্র আবারও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর চিরুনি অভিযানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলেও সময়-সুযোগ পেলেই তারা ফের সক্রিয় হয়ে উঠবে। তাই তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই শক্ত হাতে প্রতিহত করা জরুরি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ নিয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দলের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে উত্তর আওয়ামী লীগের মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, 'পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ঘাপটি মেরে আছে। তারা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা নিতে চায়। তারেক রহমান লন্ডনে বসে দেশ ধ্বংসের পরামর্শ দিচ্ছে। এ সময় বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনা প্রতিহত করতে দলের নেতাকর্মীদের নিজ নিজ থানায় সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।'

এদিকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কি পয়েন্ট অব ইন্সলেশনের (কেপিআই) সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলবৎ রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কোটা আন্দোলনের সুযোগে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা কীভাবে ডেটা সেন্টার, বিটিভি, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করতে সক্ষম হলো, নিরাপত্তা ব্যবস্থার সে দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা দূর করতে সরকারের শীর্ষ প্রশাসন কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।

অন্যদিকে থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্সসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত অস্থিতিশীলতা কেটে গেলেও ঘাপটি মেরে থাকা দুষ্কৃতকারীরা যে কোনো সময় ফের সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। নতুন কোনো কৌশলে সংঘাত-সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে। তাই এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দৃশ্যমানভাবে স্বাভাবিক মনে হলেও তান্ডব সৃষ্টিকারীরা এখনো ওৎ পেতে আছে বলে মনে করেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতার জেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রেন সেবা সীমিত পরিসরে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে এসেছে তারা। রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার বলেছেন, আগামী 'দুই-তিন দিনের মধ্যে' ট্রেন চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। অথচ এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার থেকে সীমিত পরিসরে ট্রেনসেবা চালু হওয়ার কথা ছিল। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির বুধবার বলেছিলেন, প্রাথমিকভাবে কারফিউ শিথিল থাকার সময়ে ঢাকা থেকে কাছাকাছি দূরত্বে কমিউটার ট্রেন চলবে। আন্তঃনগর ট্রেনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে পরে।

তবে বৃহস্পতিবার কোনো ট্রেন চলাচল করেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনের মাস্টার মাহমুদুল হাসান বলেন, 'আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল থেকে দুটি লোকাল ট্রেন চলার কথা ছিল। তবে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। কোনো ট্রেন চলেনি।' সিদ্ধান্ত কেন বাতিল হয়েছে সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির কথা দাবি করলেও তা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বলে স্বীকার করেন। বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের কারফিউ চলমান থাকা প্রসঙ্গে বলেন, সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছে। বিজিবি, পুলিশ সবাই মিলে জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কাজ করছে। সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি হচ্ছে। কারফিউর সময় নিয়ে প্রতিদিনই বৈঠক হচ্ছে। আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে কারফিউর আর প্রয়োজন হবে না।

এদিকে কারফিউ শিথিল হওয়ায় দেশের প্রতিটি জেলাতেই কর্মচাঞ্চল্য ফেরার খবর পাওয়া গেছে। অফিস-আদালত চলেছে যথারীতি। খুলেছে দোকানপাট। ফুটপাতে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি নগরীতে চলাচল করেছে ছোট-বড় সব ধরনের যানবাহন। নগরী থেকে ঢাকাসহ অন্য জেলা ও উপজেলার উদ্দেশেও ছেড়ে গেছে যাত্রীবাহী বাস। কয়েক দিন বন্ধের পর খুলে দেওয়া ব্যাংকগুলোতেও ছিল গ্রাহকদের উপচেপড়া ভিড়। কাঁচা বাজারগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

তবে কারফিউ শিথিল থাকলেও প্রতিটি জেলা শহরের বিভিন্ন মোড় ও সড়কগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ছিল গত কয়েক দিনের মতোই। নগরবাসী প্রত্যাশা করছে, দ্রম্নতই এ সংকট কেটে যাবে। আবার স্বাভাবিক হবে দেশ। সচল হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুখর হবে শিক্ষার্থীদের আনাগোনায়।

গতকাল সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরায় সালমা বেগম নামের একজন গৃহিণীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, তার হাতে থাকা টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংক খোলায় টাকা তুলে নিরাপদেই ঘরে ফিরতে পেরেছেন। ব্যাংক না খুললে তিনি বিপদে পড়ে যেতেন। তবে ব্যাংকে অন্য দিনের তুলনায় বেশ ভিড় ছিল বলে জানান তিনি।

পাঁচদিন পর মালিবাগ বাজারে বাজার করতে এসেছেন খিলগাঁও তালতলা এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'বাসার বাজার শেষ হয়েছে কয়েক দিন আগেই। কিন্তু ঘরের লোকজন কারফিউয়ের মধ্যে বাজার করার জন্য বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। আজ পরিস্থিতি ভালো। তাই বাজার করতে বের হয়েছি।'

রাজধানীর একাধিক থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা কোথাও সংঘবদ্ধ হয়ে নাশকতা কিংবা সহিংসতার ছক আটছে কিনা সে ব্যাপারে আগাম তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। নাগরিকদের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে কারফিউ শিথিল করা হলেও ওই সময়ও নগরীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল চলছে। যেকোনো ধরনের নাশকতা রোধে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে