কোটাবিরোধীদের বিরুদ্ধে বেআইনি 'শক্তি' প্রয়োগ করা হচ্ছে :অ্যামনেস্টি
প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১৮:০৬
যাযাদি ডেস্ক
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ 'বেআইনি শক্তি' প্রয়োগ করেছে। সারাদেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বুধবার এসব কথা বলেছে।
ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ শুনেছে অ্যামনেস্টি। পাশাপাশি ঘটনার ভিডিও-ছবি বিশ্লেষণ, সত্যতা যাচাই করে দেখেছে অ্যামনেস্টি ও তাদের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব। এসব বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের
বেআইনি বলপ্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের আরও বিবরণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বহু বছরের সহিংসতার ধারাবাহিকতার বিষয়টিও নিশ্চিত করে। এই সহিংসতায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক গবেষক তকবীর হুদা বলেন, শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবি জানানো আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে অ্যামনেস্টি।
তকবীর হুদা আরও বলেন, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন ও নিজস্ব সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকার অনুসারে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকারের প্রতি সম্পূর্ণভাবে সম্মান দেখাতে হবে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের আরও ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে হবে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুই দিনের বিক্ষোভে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজারো।
যেসব প্রত্যক্ষদর্শী অ্যামনেস্টির সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা বলেছেন, ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলা শুরুর আগে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক আবাসিক হল, বিশেষ করে সূর্য সেন হল ও বিজয় একাত্তর হল থেকে ছাত্রলীগের সদস্যদের রড, লাঠিসোঁটা, এমনকি পিস্তল নিয়ে বের হয়ে আসতে দেখা যায়।
২০২৩ সালে অ্যামনেস্টি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার বিবরণ নথিভুক্ত করেছিল। সেই সহিংসতার সঙ্গে এই সহিংসতার বিবরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অমিত (ছদ্মনাম) নামে এক বিক্ষোভকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলার শিকার হন। হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের হাতে কিছুই ছিল না, আমাদের কাছে কেবল পস্ন্যাকার্ড ও পতাকা ছিল...তারা আমাদের দিকে ইট ছুড়তে শুরু করেন এবং তারপর লোহার রড দিয়ে...। তারা ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ করেননি। তারা মেয়েদের দেহের স্পর্শকাতর জায়গায়, পেটে ও মাথায় লাথি মেরেছেন।'
অ্যামনেস্টি সড়কে, হাসপাতালের ভেতরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ভিডিও যাচাই করেছে, যা প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণকে সমর্থন করে। অ্যামনেস্টির যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ১৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢোকার চেষ্টাকালে কিছু ছেলে তাদের হাতে থাকা অস্ত্র তুলে ধরছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী রিমাসহ (ছদ্মনাম) আহত অন্য আন্দোলনকারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দ্বিতীয় দফায় হামলার শিকার হন।
রিমা বলেন, 'পুলিশ হাসপাতালে ছিল, তবু ছাত্রলীগ জরুরি বিভাগে এসে আবার আমাদের ওপর হামলা শুরু করে। রাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে নামিয়ে দিয়েছে...আমরা যতবারই প্রতিবাদে নামি, সেটা ২০১৮ বা ২০২৩ সালের প্রতিবাদই হোক না কেন, আমাদের দমন করার শক্তি হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা হয়েছে।'
রিমা আরও বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি আশা করি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল কর্তৃপক্ষ আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরা রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে ছিলাম এবং আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওপর থেকে আমাদের দেখতে দেখেছি...। আমরা পালানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অফিস ভবনগুলোতে তালা লাগানো ছিল। আমরা ভেতরে ঢুকতে দিতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু কেউ দরজা খোলেনি। এটা শুধু ব্যর্থতা নয়, ছাত্রলীগের সহিংসতার সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা আছে।'
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছর বয়সি প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি অবিরাম বমি করছিলেন। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওই শিক্ষার্থীর সাদা জামা রক্তে পুরোপুরি ভিজে গিয়েছিল।' প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তারা তার পকেট থেকে মুঠোফোন উদ্ধার করেন যা টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল। কল্পনা করুন, ফোনটি কারও পকেটের ভেতরে থাকা অবস্থায় সেটি টুকরা টুকরা হতে কী ধরনের শক্তির দরকার হয়।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর রংপুরে আবু সাঈদ নামে ২৫ বছর বয়সি এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। অ্যামনেস্টির যাচাই করা দুটি ভিডিওতে অন্তত দুজন পুলিশ সদস্যকে রাস্তার ওপার থেকে সরাসরি তাকে লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।
অ্যামনেস্টি সাঈদ ও পুলিশের অবস্থানের ব্যবধান বোঝার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি (ইমেজ) ব্যবহার করে। এতে দেখা যায়, গুলির সময় সাঈদ ও পুলিশ সদস্যের মধ্যকার দূরত্ব ছিল প্রায় ১৫ মিটার। এ ছাড়া ঘটনার সময় পুলিশের প্রতি দৃশ্যত কোনো শারীরিক হুমকি সৃষ্টি করেননি সাঈদ। তার মৃতু্যসনদে বলা হয়েছে, তাকে হাসপাতালে 'মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে'।
সাঈদের বুকে ক্ষতের ছবি পরীক্ষা করেছেন স্বাধীন ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট ডেরিক পাউন্ডার। তিনি অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, শটগানের গুলিতে সৃষ্ট ক্ষতের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য আছে।
অ্যামনেস্টির তকবীর হুদা বলেন, এটি আপাতদৃষ্টে ইচ্ছাকৃত, একজন ব্যক্তির ওপর বিনা উসকানির আক্রমণ ছিল, যিনি পুলিশের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন না। পুলিশের বিক্ষোভ মোকাবিলায় গুলির ব্যবহার অত্যন্ত বিপজ্জনক ও বেআইনি।
শটগান থেকে গুলির ব্যবহারকে পুরোপুরি অনুপযুক্ত বলে মনে করে অ্যামনেস্টি। বিক্ষোভ মোকাবিলায় পুলিশের কখনোই এটি ব্যবহার করা উচিত নয়।
শটগান থেকে ছোড়া কার্তুজে ধাতব ছররা থাকে যা ত্বকে প্রবেশ করে গুরুতর জখম করতে পারে। মিসর, ভারত, ইরানে একাধিক মৃতু্য, অন্ধত্বের কারণ হিসেবে এর ব্যবহার দায়ী।
অ্যামনেস্টির তকবীর হুদা বলেন, তারা জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সব আহত ব্যক্তির পুনর্বাসন এবং তাদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত সবার জবাবদিহি অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। এসব হামলাকারীর ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও দ্রম্নত তদন্ত পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশের যেসব সদস্য সরাসরি জড়িত বা আইনের লঙ্ঘন প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও নিরপেক্ষ, স্বাধীন, দ্রম্নত তদন্ত করতে হবে।