কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কমপিস্নট শাটডাউন কর্মসূচিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারও ঢাকাসহ সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট এবং ইটপাটকেল, ককটেল ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে এক শিশুসহ ৩২ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে শুধুমাত্র রাজধানীতেই মারা যান ২২ জন। ক্ষুব্ধ জনতার গণরোষের শিকার হয়ে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের দেহরক্ষী রানা মোলস্নার মৃতু্য হয়। এছাড়া গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। ঢাকার বাইরে রংপুরে ৫ জন, মাদারীপুরে ২ জন, বগুড়ায় ১ জন, সাভারে ১ জন ও মাধবদীতে ১ জন নিহত হয়েছেন।
এদিকে শুক্রবার রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে রাত সাড়ে ১১টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
দুপুর থেকে নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সংঘর্ষ চলাকালে জেলখানার গেট ভেঙে আন্দোলনকারীরা ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ সময় বিপুল সংখ্যক হাজতি ও কয়েদি পালিয়ে গেছে। যদিও জেল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে এদের সংখ্যা ৪ জন বলে দাবি করেছে। তবে স্থানীয়রা অনেকে জানিয়েছেন, কারাবন্দি বেশিরভাগ আসামি ও কয়েদিই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গেছে। ঘটনার ভয়াবহতায় হতভম্ভ কারারক্ষীসহ অন্যরা কাউকে বাধা দিতে সাহস পাননি। বরং তারা আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপন করেন। বিষয়টি জানতে নরসিংদী জেল সুপারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও
তিনি তা রিসিভ করেননি।
এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে পিবিআই কার্যালয়, বিজিবি ক্যাম্প, পাসপোর্টের আঞ্চলিক অফিস, গুলশানে সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, মহাখালী ডাটা সেন্টার, ডিজি হেলথ অফিস, ডজনখানেক পুলিশ বক্স ও অর্ধশতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক কার্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিপুল সংখ্যক স্থাপনা।
সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পট আন্দোলনকারীরা অবরোধ করে রাখায় দূরপালস্নার যান চলাচল বন্ধ ছিল। ঢাকা-চাঁদপুরসহ বেশকিছু রুটে দিনভর নৌ চলাচল করেনি। ঝুঁকি নিয়ে স্বল্প সংখ্যক আন্তঃজেলা পরিবহণ বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেলেও যাত্রী সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। আগাম টিকিট কেটেও অনেকে শুক্রবার রেলে চড়তে সাহস পাননি। তবে রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলায় ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সারাদেশে সব ধরনের তথ্য প্রবাহ ও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে দেশের মানুষ কোথায় কী ধরনের সংঘর্ষ ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, কতজন নিহত হয়েছেন এ ব্যাপারে ছিল পুরোপুরি অন্ধকারে। উৎসুক অনেকে এসব তথ্য জানতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সংবাদকর্মীদের ফোন করেন। তবে সাংবাদিকদের কাছেও অধিকাংশ ঘটনার ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য ছিল না। এ জন্য তাদের নিজস্ব সংবাদদাতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
এদিকে শুক্রবারের আন্দোলনের ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্পটে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি থাকলেও তাদের পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। এছাড়াও পল্টন, জাতীয় প্রেস ক্লাব ও মতিঝিলসহ বেশকিছু পয়েন্টে বিএনপির নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে রাজপথে নামেন।
পুলিশের দাবি, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিপুল সংখ্যক স্পটে অবস্থান করলেও বেশিরভাগ সংঘর্ষ, নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা এ সময় আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করে।
তবে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে তাদের হত্যা করছে। এতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা বেপরোয়া পুলিশকে প্রতিহত করতে বিভিন্নস্থানে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের সহিংস ঘটনা ও নাশকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাই এ দায়ভার তারা বহন করবেন না।
জানা গেছে, শুক্রবার দুপুরে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য গাজীপুর থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের গাড়ি বহর নিয়ে আসছিলেন। পথিমধ্যে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে আন্দোলনকারীরা তাদের গাড়ি বহর আটক করে। উত্তেজিত জনতা জাহাঙ্গীর আলম ও তার বডিগার্ড রানা মোলস্নার ওপর আক্রমণ করে। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেও রানা মোলস্না গণপিটুনির শিকার হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে বরিশালে শহর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামানসহ ৭ জনকে কোপানো হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্থানীয়রা জানান, দুপুরে ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীরা নগরীর হাতেম আলী কলেজের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় সেরনিয়াবাদ সাদেক আব্দুলস্নাহর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দু'পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। আওয়ামী ক্যাডাররা ধারালো অস্ত্র নিয়ে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় এবং ৭ জনকে কুপিয়ে জখম করে।
অন্যদিকে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় দুই শতাধিক জায়গায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় আন্দোলনকারীরা সকাল থেকে অবস্থান করলেও জুমার নামাজের পর সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় বিভিন্ন গলির মুখে লাঠিসোটা হাতে আন্দোলনের বিপক্ষের লোকজন অবস্থান করতে দেখা গেছে। যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের লোকজন।
এ পরিস্থিতিতে ঢাকার রাস্তায় এবং বাসাবাড়িতে থাকা লোকজনের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। রাস্তাঘাট ছিল পুরোপুরি ফাঁকা। রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসসহ জরুরি কাজে নিয়োজিত যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। গণপরিবহণ ছিল না বললেই চলে। প্রতিটি রাস্তার আশপাশে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর পুলিশ,র্ যাব ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, এমন পরিস্থিতির মধ্যেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আন্দোলনকারীরা জোটবদ্ধ হয়ে আচমকা মিছিল নিয়ে গলি দিয়ে বের হওয়া শুরু করেন। এ সময় গলির সামনে থাকা আন্দোলনের বিপক্ষের লোকজন তাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ওপর শুরু হয় সংঘর্ষ। এমন চিত্র পুরো ঢাকাজুড়ে।
সূত্রটি জানিয়েছে, প্রথমে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া দিয়ে শুরু হয়। পরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ, হামলা, পাল্টা হামলা ও গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঢাকার উত্তরার তুরাগ থানাধীন আশুলিয়া সড়কের তিন রাস্তার মাথায়, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের রানাভোলা এলাকা, কামারপাড়া, আব্দুলস্নাহপুর, জসীমউদ্দীন সড়কের মোড়ে, আব্দুলস্নাহপুর তালুকদার ফিলিং স্টেশনের সামনে, টঙ্গী বিশ্ব এজতেমা ময়দানের পাশে কামারপাড়া চৌরাস্তা মোড়, আহসান উলস্নাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহসান উলস্নাহ ক্যান্সার হাসপাতালের সামনে, টঙ্গী ব্রিজের ওপরে, আব্দুলস্নাহপুর পুলিশ পস্নাজার সামনে, খিলক্ষেত মোড়, রাজলক্ষ্ণী কমপেস্নক্সের সামনে, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর সড়ক, কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত নিকেতন এলাকা, বিমানবন্দর রেলস্টেশন ও হাজী ক্যাম্পসহ প্রায় প্রতিটি স্পটে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে আন্দোলনকারী, পুলিশ, সাধারণ মানুষ, পথচারী, উৎসুক জনতাসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে মিরপুরের কালশী, ইসিবি চত্বরের আশপাশের এলাকা, পলস্নবী বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর-১৩, মিরপুর-১০, দারুস সালাম থানাধীন গাবতলী, আমিনবাজার ব্রিজের ঢালে, দারুস সালাম এলাকার লালকুঠি বেসরকারি প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, মোহাম্মদপুর, বছিলা, রামপুরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকার দুই শতাধিক জায়গায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের সময় মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পুরনো ছয়তলা ভবনটি পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। একই সঙ্গে সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, ডাটা সেন্টার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভবনে আগুন দেওয়া হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে হেলিকপ্টার দিয়ের্ যাব টহল দেয়। এ সময় আকাশ থেকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালানো হয়।
এদিকে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিএনপির ডাকা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি সমাবেশ ও মিছিল করতে দেয়নি পুলিশ। এর প্রতিবাদে রাজধানীর সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, শান্তিনগর নয়াপল্টন, মালিবাগ, মৌচাক এলাকায় পুলিশের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে পুলিশি হামলায় কমপক্ষে দুই কর্মী নিহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে শুক্রবার বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় ঐক্য সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই কর্মসূচি সফলে সকাল থেকে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা প্রেস ক্লাবের আশেপাশে জড়ো হতে শুরু করে। নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিয়ে জমায়েত হতে বাধা দেয়। এ সময় কয়েকজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ ধাওয়া দিলে প্রথমে সেগুনবাগিচার বারডেম-২ হাসপাতালের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ তাদের উদ্দেশে মুহুমুর্হু গুলি, রাবার বুলেট টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে ইটপাটকেল ছুড়ে নেতাকর্মীরা এর জবাব দেয়। একপর্যায়ে এই সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ছড়িয়ে পড়ে বিজয়নগর, শান্তিনগর, নয়াপল্টন এলাকায়। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার চেষ্টা করে বিএনপি। তারা পুলিশের লাগানো তালা ভেঙে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করে। সেখানে সমাবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দিলে আবারো সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল নিক্ষেপের কারণে নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন বিভিন্ন গলিপথে। সে সময় কাকরাইল পুলিশ বক্সে নেতাকর্মীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর শান্তিনগরে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের নেতৃত্ব শত শত নেতাকর্মী অবস্থান নেন। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। যা সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখার সময়ও চলছিল। অন্যদিকে কালভার্ট রোডে সংঘর্ষের সময় দলের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির। তিনি বলেন, যুবদল ও ছাত্রদলের দুই কর্মী তার সামনে কালভার্ট রোডে নিহত হয়েছেন। এছাড়া সংঘর্ষে ছাত্র, যুব ও মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন।
এদিকে প্রেস ক্লাবের সামনে পুলিশি বাধায় পন্ড হয় গণতন্ত্র মঞ্চের বিক্ষোভ সমাবেশও। এ সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। অন্যদিকে জুমার নামাজের পর চরমোনাই পীরের অনুসারীদের ছাড়াও কয়েকটি ইসলামি সংগঠন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে বাধে সংঘর্ষ। পুরো এলাকা তখন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
পল্টনে আজাদ প্রোডাক্টস গলি ও মৎস্য ভবন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ৫ ঘণ্টা সংঘর্ষ হয়। এ সময় চরমোনাই পীরের অনুসারীদের বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন।
স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, সকাল ১০টা থেকে রায়েরবাগ ও শনির আখড়া এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় পুলিশকে রাস্তার দুই পাশের ছাদ থেকে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে দেখা গেছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে উলেস্নখ করেছেন একাধিক পথচারী। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের মুখে কিছুক্ষণ পরপরই ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। দিনভর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে।
এদিন দনিয়া কলেজের গেট ভেঙে ফেলে আন্দোলনকারীরা। কলেজের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েন তারা। তবে সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
শুক্রবার দিনভর সংঘর্ষে ঢাকায় নিহতের সংখ্যা ২২ জন। এদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
বাড্ডায় নিহত হয়েছেন স্যানেটারি মিস্ত্রি গনি শেখ (৪০), রামপুরা ব্রিজ এলাকায় বিদু্যৎ অফিসের কর্মী গোলাম রাব্বি রাকিব (২৭), বাড্ডার লিংক রোডে ডেলিভারিম্যান সোহাগ (১৯), যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে অজ্ঞাত যুবক (২০), রবিউল (৩০), রায়েরবাগের ইলেক্ট্রিক দোকান মালিক মোবারক (৩২) ও ইমন (২৫), যাত্রাবাড়ীর কাজলায় হোটেল বয় আরিফ (১৮) ও শান্ত (২০), নয়াপল্টনে পাভেল (২৫), বাড্ডার শাহজাদপুরে অজ্ঞাত তরুণ (১৮), পুরান ঢাকার লক্ষ্ণীবাজারে কবি নজরুল ইসলাম কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ওমর ফারুক (২৩), শনির আখড়ায় একই কলেজের শিক্ষার্থী জিহাদ (২২), মিরপুর-১০ আবু তালেব স্কুলের সামনে রাব্বি (২৭), নিউমার্কেটে চায়না ভবনের সামনে পুলিশের গুলিতে ওদুদ (৪০), মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় মামুন (২৭), নিউমার্কেট এলাকায় অজ্ঞাত যুবক (২০), শাওন (২৫), শোভন (২৫), রামপুরা ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মারুফ (২৫), দৈনিক বাংলার মোড়ে আনসার জুয়েল (৩৫) ও মোহাম্মদপুরের বছিলায় মনছুর (৪০) নিহত হন।
দৈনিক যায়যায়দিনের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থানরত পুলিশের ওপর আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পরবর্তীতে মদীনা মার্কেট থেকে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে এসে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে ২০ জনের মতো হতাহতের খবর পাওয়া যায়। বৃহস্পতিবার পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় রৌদ্র সেন নামে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্সের ২য় বর্ষের একজন ছাত্র পুকুরের পানিতে পড়ে মারা যান। নিহতের বাড়ি দিনাজপুর বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের ডাকা কমপিস্নট শাটডাউনের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় রংপুর, মাদারীপুর, সিলেট, বগুড়া ও নরসিংদীতে সাংবাদিকসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। যায়যায়দিনের অফিস, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত তথ্য-
স্টাফ রিপোর্টার, মাদারীপুর জানান, শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে মাদারীপুরের মোস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ডে কোটাবিরোধী ছাত্র-জনতা অবস্থান নেয়। এই সময় তারা পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা আওয়ামী লীগের অধীনে থাকা বাস কাউন্টারে ভাঙচুর চালায়। এরপর আন্দোলনকারীরা মোস্তফাপুর পলস্নী বিদু্যৎ অফিসেও ভাঙচুর করে। পরবর্তীতে স্থানীয় এমপি শাজাহান খানের মালিকানাধীন সার্বিক পেট্রোল পাম্প ও সার্বিক পরিবহণ নামে প্রায় ১০-১৫টি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে মাদারীপুর শহরের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।
এ সময় পুলিশের গুলিতে রোমান (৩২) নামে এক পথচারী ও আন্দোলনকারী তাওহীদ সন্যামত (২০) নিহত হন। নিহত রোমান সদর উপজেলার ভদ্রখোলা গ্রামের আমর বেপারীর ছেলে ও তাওহীদ সদর উপজেলার সুচিয়া ভাঙ্গা মোস্তফাপুর নাসির সন্যামতের ছেলে। এ সময় আন্দোলনকারী, পুলিশ ও পথচারীসহ অন্তত অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলছে।
সিলেট অফিস জানায়, সিলেটে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদলের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ ঘটে। শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চলে। এতে অর্ধশতাধিক আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দৈনিক জালালাবাদের ফটো সাংবাদিক আবু তোরাব নিহত হন। এ ঘটনায় ৮-১০ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বগুড়া প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বগুড়া শহরের শেউজগারী আমতলা মোড়ে পুলিশের গুলিতে সিয়াম (১৬) নামে একজন নিহত হয়েছেন। বগুড়া নার্সিং হোম হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. এ এইচ মশিহুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। পরে মরদেহ নিয়ে কয়েকজন যুবক বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। নিহত সিয়াম শহরের শেউজগারী বাসিন্দা।
নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে রায়পুরা উপজেলার থানাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনে থেমে থাকা কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। এর আগে সকাল ৯টায় বেলানগরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে একটি যাত্রীবাহী সিএনজিতে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এ ঘটনায় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে নরসিংদী জেলা পরিষদ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলকারীরা।
এর আগে জুমার নামাজের পর শহরের বেশ কয়েকটি মসজিদ থেকে মুসলিস্নরা ছাত্রদের বিরুদ্ধে হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
এদিকে নরসিংদীর মাধবদীতে গুলিতে এক ছাত্র নিহত ও কমপক্ষে ২০জন আহত হয়েছেন। মাধবদী পৌরসভা, পোস্ট অফিসসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায় আগুন জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। বর্তমানে মাধবদীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনকারীদের হাতে। মাধবদীর মেয়র মোশারফ হোসেন মালিককে আন্দোলনকারীরা ঘেরাও করে অফিসের নিচে আগুন ধরিয়ে দেয়। বন্ধ রয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যান চলাচল।
শুক্রবার দুপুরের আগে আন্দোলনকারীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্পট অবরোধ করে। তবে দুপুরে জুমার নামাজের পর তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় পুলিশ তাদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে দু'পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলা চালায় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।