ঢাকার চারপাশে চার উপশহর গড়ে তোলার উদ্যোগ
রাজধানীর জনঘনত্ব নিরসন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে
প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০
বীরেন মুখার্জী
জনঘনত্ব নিরসন ও রাজধানী সম্প্রসারণে ঢাকা শহরের চারপাশে চারটি উপশহর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য নেওয়া হয়েছে চারটি মেগা প্রকল্প। ঢাকার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে এসব উপশহরে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এর মধ্যে একটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে এখন চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। বাকি চারটিরও সম্ভাব্যতা যাচাই শেষের পথে। প্রকল্পগুলো গতানুগতিক থেকে ভিন্ন ধরনের হবে। প্রচলিত পস্নটের পরিবর্তে দেওয়া হবে বস্নকভিত্তিক বরাদ্দ। আবার শিক্ষার জন্য থাকবে বিশেষ অঞ্চল। নদীভিত্তিক একটি প্রকল্প রয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে তুরাগ ওয়াটার বেজড। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে গোটা রাজধানীর অবয়ব। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এসব উপশহর প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৮ মার্চ মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় এসব প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। সরকারের এই প্রতিষ্ঠান দু'টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৯ থেকে ১২টি স্থানের প্রস্তাব জমা দেয়।
জানা যায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও ধামরাই, নারায়গঞ্জের সোনারগাঁ ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় উপশহর গড়ে তোলার প্রতিবেদন দাখিল করেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জে স্মার্ট সিটি এবং তুরাগ ওয়াটার বেজড সিটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চীনের একটি কোম্পানি এসব প্রকল্পের সমীক্ষা যাচাইয়ের কাজ (ফিজিবিল্যাটি স্টাডি)
শেষ করেছে।
এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার একটি সংবাদমাধ্যমে বলেন, 'রাজধানী সম্প্র্রসারণ করতে এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ঢাকার পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে গড়ে তোলা হবে এসব প্রকল্প। মূলত রাজধানীতে জনঘনত্বের চাপ কমাতেই এসব নতুন উপশহর গড়তে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়োগ দিয়েছেন। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া প্রকল্পের কাজগুলো দ্রম্নত বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া রাজউকে ভালো কিছু করার জন্য সব কিছু ডিজিটাল করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকার রূপ বদলে যাবে। নতুন দিগন্তের ছোঁয়া লাগবে।'
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণপ্রান্তেই ঝিলমিল সংলগ্ন নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন। ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে রোডের পাশে কেরানীগঞ্জ উপজেলার ঝিলমিল প্রকল্পের কাছেই নতুন উপশহরে থাকবে একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ওয়্যার হাউস, ব্যাংকপাড়া। উপশহরটিতে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে।
এ প্রকল্পের একেকটি ভবনের উচ্চতা হবে কমপক্ষে ২০ তলা। প্রকল্প এলাকায় ২০ শতাংশ জায়গা রাখা হবে গ্রিন স্পেস ও জলাভূমি হিসেবে। এছাড়া মাঠ, বাজারসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এই উপশহরকে বিজনেস হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চায় রাজউক। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ঘোষণার পর এটিকে প্রথম বস্নকভিত্তিক উন্নয়ন করে আন্তর্জাতিকমানের একটি শহর গড়ার পরিকল্পনা করেছে রাজউক।
রাজউক সূত্র জানায়, উপশহরটির প্রধান লক্ষ্য কর্মসংস্থান। পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণবঙ্গের কৃষিপণ্য সহজেই ঢাকায় প্রবেশ করতে পারছে। কাজেই ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের পাশে যদি একটি উপশহর গড়ে ওঠে, সেটি হবে দেশের বিজনেস হাব। এতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ প্রকল্পে অর্থের জোগান নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে চায় রাজউক। সেটি সম্ভব না হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় কাজ করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর থেকে ৭ বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় রাজউক। এজন্য দেশি বড় বড় আবাসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হতে পারে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানকে লিজও দেওয়া হতে পারে। দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করেই এই শহর গড়া হবে। এখানে প্রচলিতভাবে সিঙেল পস্নট দেওয়া হবে না। এখানে থাকবে বস্নকভিত্তিক বড় বড় পস্নট। বেশিসংখ্যক মানুষের বাসস্থান সংকুলানের জন্যই নেওয়া হয়েছে এ পদ্ধতি। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন শহরের মানদন্ড মাথায় রেখে আন্তর্জাতিকমানের শহর গড়ার ভাবনা থেকেই এটা হাতে নেওয়া হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, কেরানীগঞ্জে আগে যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেটা এখন ছোট করে ফেলা হয়েছে। যেসব স্থানে ঘরবাড়ি আছে সেগুলো বাদ দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেসব ক্ষতিগ্রস্তের জন্য একটি অঞ্চল তৈরি করে পস্নট দেওয়া হবে। এতে ওই এলাকার উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান একটি সংবাদমাধ্যমে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৌখিক নির্দেশনা পেয়েই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ডিপিপি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। তারপর যাবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে। এটি আন্তর্জাতিকমানের উপশহর হবে।
এদিকে, কেরানীগঞ্জের পাশেই মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায় জরিপ কাজ শেষ। এখানেও গড়ে তোলা হবে বিশেষ প্রকল্প। অত্যাধুনিক এই প্রকল্পে প্রাধান্য দেওয়া হবে স্থানীয়দের।
রাজউকের পরিকল্পনা রয়েছে, নবাবগঞ্জ-দোহার-মাওয়া এলাকায় পদ্মা নদীর পাড়ে একটি প্রকল্প করার। পূর্বাচলের দক্ষিণে হবে শিক্ষা জোন আর পূর্বদিকে হবে আরেকটি আবাসন প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিশুপুত্র শেখ রাসেলের নামে 'শেখ রাসেল ওয়াটার বেজড বিনোদন পার্ক' নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে নিয়েছে রাজউক। ঘাটারচরের ওই স্থানের বেশিরভাগই নালা-ডোবা। সরকারি খাস হিসেবে চিহ্নিত ওসব জমির কিছু অংশ দখলদাররা ভরাট করে দখল করে রেখেছে। তাদের উচ্ছেদ করে সেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এখানকার ডোবা ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই পরিকল্পনা করা হয়েছে শেখ রাসেল ওয়াটার বেজড পার্ক। শেখ রাসেল ওয়াটার বেজড বিনোদন পার্কের কাজটা দ্রম্নতই শুরু হবে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর সংলগ্ন বছিলা ব্রিজ পার হয়ে সামনের ঘাটারচর এলাকায় ৫০ দশমিক ৭০ একর জমির ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৭২ একর খাসজমি। বাকিটা আশপাশ থেকে অধিগ্রহণ করা হবে। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫শ' কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বিনোদন পার্ককে আকর্ষণীয় করার জন্য থাকবে এম্ফিথিয়েটার, কমিউনিটি সেন্টার, অফিস ভবন, ওয়াচ টাওয়ার, ব্যায়ামাগার, আধুনিক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, সাঁতার কাটা, নৌকা ভ্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের বনভোজন বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকবে।
অন্যদিকে, 'তুরাগ ওয়াটার বেজড মডেল টাউন' নামে রাজধানীর আমিনবাজার, মিরপুর, সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের কাশিমপুরের অংশবিশেষ নিয়ে একটি বৃহৎ আবাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজউক। তুরাগ তীর ঘেঁষে সাভার ও আশুলিয়ার বিশাল এলাকা ভূমিদসু্যদের হাত থেকে রাজউক রক্ষা করতে পারছে না। বর্ষা মৌসুমে রাতে নৌকায় করে তারা বালু ফেলে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতেই সেখানে চর জেগে ওঠে। এভাবে আশুলিয়ার বিশাল এলাকা ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গাছপালা গজিয়েছে। এ জন্যই আমিনবাজার থেকে কাশিমপুর পর্যন্ত পুরো এলাকা অধিগ্রহণ করে তুরাগ নদ ও ডোবাগুলো রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে। এখানেও যেসব স্থান ভরাট হয়ে গেছে সেখানে পস্নট বানিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হবে।