কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি
সরকারি চাকরিতে ৯৩% নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে
প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৩
যাযাদি রিপোর্ট
কোটা সংস্কার নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে মঙ্গলবার কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এর আগে রোববার সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পর মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, বাকি ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ রায় দেন। পরদিন রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রজ্ঞাপন জারির অনুমোদন দেন।
মঙ্গলবার আইনমন্ত্রীর গুলশানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে কোটার প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টি সাংবাদিকদের জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব উপস্থিত ছিলেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্ব-শাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সব গ্রেডে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গণাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্যপদসমূহ সাধারণ মেধা তালিকা হতে পূরণ করা হবে। কোটা পদ্ধতি-সংক্রান্ত আগের সব পরিপত্র-প্রজ্ঞাপন-আদেশ-নির্দেশ-অনুশাসন বাতিল করা হয়েছে।
আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে সরকার :আইনমন্ত্রী
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'আপিল বিভাগের রায় প্রতিপালন করেই কোটার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে যেসব সহিংসতা হয়েছে, এর জন্য বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া সহিংসতায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে সরকার।'
শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, 'শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কার চেয়েছিল, সরকার সেটি করেছে। এখন জনগণের চাওয়া শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব জায়গায় ফিরে গিয়ে লেখাপড়া শুরু করুক।'
আনিসুল হক বলেন, 'কোটা আন্দোলনে যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার দেখভাল করবে। যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী কোটাবিরোধী আন্দোলন করছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে সেগুলো আমরা দেখব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে সরকার।'
নারী ও জেলা কোটা না থাকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, 'কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে নারীরাই বলেছেন, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন, এর কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী। অনেক কিছুই এখন নারীরা পারছেন।'
আনিসুল হক বলেন, 'আমি বলেছিলাম, মঙ্গলবারের মধ্যে কোটা রায়ের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। সরকার মঙ্গলবার আপিল বিভাগের এই ঐতিহাসিক রায়ের প্রজ্ঞাপন জারি করল। এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবির সমাধান হয়েছে।'
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের চলমান প্রেক্ষাপটের বেশকিছু পদক্ষেপ উলেস্নখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, '২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন। কোটা বাতিলের পর বীর মুক্তিযোদ্ধার কয়েকজন সন্তান হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন, সেই রিট পিটিশন শুনানি হওয়ার পর হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ একটি রায় দেন, সেই রায়ে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন এবং বাতিল করে দেন। রায় বাতিল করে পুনর্বহাল করা হলে সেটার বিপক্ষে তিন দিনের মধ্যে আপিল বিভাগে আপিল করে সরকার। কারণ, সরকার কোটা বাতিলের পক্ষে ছিল। কোটা বাতিল চেয়ে যখন সরকার আপিল করে তখনো কোটা আন্দোলনকারীদের কেউ পক্ষভুক্ত হয়নি। সে ক্ষেত্রে চেম্বার জজ আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চে পাঠানো হয়। তখন আপিল বিভাগ একটি তারিখ নির্ধারণ করে দেন। কোটা আন্দোলনকারীরা আপিল শুনানির আগে পক্ষভুক্ত হন।'
তিনি উলেস্নখ করেন, 'পক্ষভুক্ত দরখাস্তের ওপর যখন শুনানি হয়, তখন আপিল বিভাগ একটা আদেশ দেন। সেই আদেশে আপিল বিভাগ পরিষ্কারভাবে বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় বাতিল করেছে, সেটা অকার্যকর থাকবে। যতদিন পর্যন্ত আপিল বিভাগে শুনানি না হবে। এরপরও কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করে যাচ্ছিল, অন্যদিকে কিছু মহল এই আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিতে অবলম্বন করে। একপর্যায়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেন, আন্দোলনের পাশাপাশি তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশে আমি নিজেই বলেছিলাম, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা আলোচনায় বসতে চাইলে সরকার রাজি আছে। পরে আমরা কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলাম। ওই আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করে বলেছিলাম, কোটার বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেটার সুষ্ঠু সমাধানে আসা সম্ভব।'
আইনমন্ত্রী বলেন, 'কোটা পদ্ধতি সংস্কারের মামলাটি আপিল বিভাগে রয়েছে, সেই মামলাটি আগস্টের ৭ তারিখে শুনানি হওয়ার কথা ছিল, যা আমরা এগিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা করব। সেই দিনই অ্যাটর্নি জেনারেল কোটা পদ্ধতি সংস্কার মামলাটি এগিয়ে এনে জুলাইয়ের ২১ তারিখে নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। পরে কোটা সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত রায় দেন। আপিল বিভাগ বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে কোটার ব্যাপারে একটা নির্দেশনাও দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, কোটা পদ্ধতিতে মেধায় ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধীদের ১ শতাংশ এবং নৃ-গোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে।'
দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে : তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী
এদিকে, দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, 'শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন থেকে সুবিধা নেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সারা বিশ্ব থেকে দেশকে বিচ্ছিন্ন করতেই বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা দেশের কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টার জ্বালিয়ে দিয়েছে। সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে।'
তিনি বলেন, 'দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের কার্যত ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, যার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠে। বিএনপি-জামায়াত চক্র জানত যে, তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সারাদেশে ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে পারলে, বিদেশে অপতথ্য পাঠানো সম্ভব হবে, যা বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হবে এবং একপাক্ষিক মিথ্যা তথ্য পৌঁছে দেবে।'
মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, 'আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সন্ত্রাসীদের চালানো হামলার খবর প্রকাশ করা হয়নি, সরকার শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে, যা ইতোমধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হয়েছে।'
বিশ্বের কাছে অপতথ্যের বিরুদ্ধে সত্য তথ্য তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'সরকার ইন্টারনেট চালু করেছে। আপনাদের বিশ্বকে জানানো উচিত বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশে কি ঘটেছে।'
ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চালানো ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কথা উলেস্নখ করে আরাফাত বলেন, 'আপনি যখন আক্রান্ত হন, তখন নিজেকে রক্ষা করা আপনার অধিকার। যখন আমরা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলাম তখন সংঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। কাজেই, হামলাকারীরাই হতাহতের জন্য দায়ী।'
হতাহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও শোক জানিয়ে আরাফাত বলেন, 'এটা আমাদের পরিষ্কার বার্তা যে, হতাহতের জন্য যারাই দায়ী হোক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।