এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার সহায়তায় ধাপে ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়ন হয়েছিলেন আলোচিত জাহাঙ্গীর আলম। পিয়ন হওয়ার আগে তিনি ধানমন্ডির সুধা সদনে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি মালির কাজও করেছেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। পর্যায়ক্রমে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন হলেও ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে অন্তত চারশ' কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, যা খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন।
এদিকে ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া আলোচিত জাহাঙ্গীর আলম যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই রবিবার রাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সোমবার বিকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন জাহাঙ্গীরের বড় ভাই মো. মীর হোসেন। তিনি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জাহাঙ্গীরের বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন খিলপাড়া গ্রামে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় আশির দশকে ঢাকায় আসেন। ওঠেন মিরপুরের ভাষানটেক এলাকার একটি বস্তিতে। সেখানেই বসবাস করতেন। অর্থাভাব ছিল প্রকট। যদিও আওয়ামী লীগ ছিল তার পছন্দের দল। দলীয় আদর্শের পাশাপাশি খাবার আর টাকার জন্য তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। এভাবেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তার। পরবর্তীতে তিনি মিছিলের আগে থেকে সেস্নাগান দেওয়াসহ নানা কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার নজরে আসেন। বর্তমানে ওই আওয়ামী লীগ নেতা একজন এমপি এবং খুবই ক্ষমতাধর। অঢেল অর্থ সম্পদও আছে এই এমপি'র।
সূত্র বলছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপদগামী সেনা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রম্নয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকেই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন জীবন শেষে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়িটি দেখাশোনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। বাড়িতে ময়লা জমা ছাড়াও গাছপালাগুলো মলিন হয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ওই নেতার কাছে বিশ্বস্ত লোক চাওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে দলের পরীক্ষিত লোক হিসেবে আলোচিত জাহাঙ্গীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি বাড়িটির ভেতরে থাকা বাগান পরিষ্কার করতেন। অনেকেই তাকে ওই সময় থেকেই মালি হিসেবে চিনতেন।
পরবর্তীতে ট্রাস্টিই বোর্ডই ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িটি 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি যাদুঘর' হিসেবে ঘোষণা করে।
সূত্র বলছে, পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর ধানমন্ডির সুধা সদনে যাতায়াত করতে থাকেন। ওই সময় নেতাকর্মীদের পদভারে মুখর থাকত বাড়িটি। ১৯৯০ সালের আন্দোলনের সময় আগত নেতাকর্মীদের পানি পান করাতেন জাহাঙ্গীর। এজন্য অনেকেই তাকে 'পানি জাহাঙ্গীর' আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনাকে একটি গাড়িতে নিরাপদে সরিয়ে নেন। ওই সময় শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত গাড়িটি পিছু পিছু জাহাঙ্গীর চালিয়ে নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এজন্য অনেক সময় জাহাঙ্গীর নিজেকে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত গাড়িচালক বলেও পরিচয় দিতেন পরিচিতজনদের কাছে। অনেকে তা বিশ্বাসও করতেন।
সূত্র বলছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রীর এক বিশেষ সহকারীর (বর্তমানে এমপি) মাধ্যমে গণভবনে যাতায়াত করার সুযোগ পান জাহাঙ্গীর। এরপর থেকেই নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী বলে পরিচয় দিয়ে নিজের আখের গোছাতে থাকেন। এ পরিচয়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কমিটির সহ-সভাপতির পদ পেয়ে যান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে নানা সুবিধা নিতে থাকেন। অবৈধভাবে উপার্জন করতে থাকেন অঢেল টাকা। এভাবেই কেটে যায় জাহাঙ্গীরের ৪০ বছর। তিনি নিজে প্রভাব খাটিয়ে তার ভাই আলমগীর হোসেনকে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার ৯ নম্বর খিলপাড়া ইউনিয়নের তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন। বর্তমানে জাহাঙ্গীরের ভাই আলমগীর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে অনৈতিক কাজ করছেন বলে তার প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে বলা হয়।
রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'আমার বাসায় কাজ করে গেছে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। এটা বাস্তব কথা। কী করে বানাল এই টাকা। যখন আমি জেনেছি, তাকে বাদ দিয়ে কার্ড সিজ করে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। যদিও তিনি তার সেই পিয়নের নাম প্রকাশ করেননি। মূলত এর পরই আলোচনায় আসে জাহাঙ্গীর আলমের নাম।'
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠায়। নির্দেশনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে বলা হয়েছে। এমনকি জাহাঙ্গীর এবং তার স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাকাউন্ট থাকলে তাও আগামী ৩০ দিনের জন্য স্থগিতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কার মনোনয়ন না পেয়ে জাহাঙ্গীর নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নামেন। নির্বাচনীয় হলফনামায় তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত বলে দাবি করেন। হলফনামায় তার সহায় সম্পত্তির বিশাল ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়।
বিবরণীতে উলেস্নখ করা হয়, জাহাঙ্গীরের স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ সাড়ে ৪ একর। মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৮২ লাখ ১২ হাজার ১১৫ টাকা। স্ত্রীর আছে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকার জমি। অকৃষি জমি আছে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা, স্ত্রীর আছে ১৯ লাখ ১০ হাজার টাকার জমি। ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি দালান আছে। মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে সাততলা ইমারত, গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে একতলা দালান মিলিয়ে আছে আড়াই কোটি টাকার সম্পদ। স্ত্রীর নামে আটতলার একটি ইমারত আছে, দাম ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। মিরপুরে আছে দুটি ফ্ল্যাট, যার দাম ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ২৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম ৭৬ লাখ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা।
কৃষি খাতে তার বছরে আয় ৪ লাখ ২২ হাজার ১০৪ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় ১১ লাখ ২১ হাজার ৫৩৩ টাকা, ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৮ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের আয় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০ টাকা। চাকরি থেকে ভাতা পান বছরে ৬ লাখ টাকা এবং অন্য উৎস থেকে আয় করেন বছরে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
অস্থাবর সম্পদ হিসাবে নগদ টাকা ব্যাংক মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ টাকা এবং স্ত্রীর নামে আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৬ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৮ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৫ টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
এছাড়া বন্ড ঋণপত্র স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় কোম্পানির শেয়ার আছে ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৭০০ টাকা, স্ত্রীর নামে আছে ২৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তার সঞ্চয়পত্র আছে ৩ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে আছে আরও ৩ লাখ টাকা।
স্ত্রীর একটি গাড়ি আছে, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। স্বর্ণ উলেস্নখ করা হয়েছে ৭৫ তোলা, যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর স্ত্রীর স্বর্ণ আছে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। আসবাব ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী আছে ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে আছে ৯ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীর একটি পিস্তল ব্যবহার করেন, যার দাম ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। অংশীদারি ফার্মে তার মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫১০ টাকা।