মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

আর্জেন্টিনা কোপা, স্পেন ইউরো চ্যাম্পিয়ন

ক্রীড়া প্রতিবেদক
  ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
কোপা আমেরিকা জয়ের পর মেসিকে ধরে অশ্রম্নসিক্ত জয়ের নায়ক লাউতারো মার্টিনেজ -ওয়েবসাইট

মঞ্চটা আগেই প্রস্তুতই ছিল। তবে অপেক্ষা কেবল উৎসবের। অপেক্ষা বিশ্বকাপজয়ী ডি মারিয়ার বিদায়ের। অপেক্ষা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৬ বার শিরোপা ঘরে তোলার। টানটান উত্তেজনা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের শেষে কোপা আমেরিকার ফাইনালে কলম্বিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি দিয়েই ডি মারিয়ার বিদায় রাঙাল আর্জেন্টিনা। এটি তাদের রেকর্ড ১৬তম শিরোপা।

সোমবার মায়ামির হার্ডরক স্টেডিয়ামে ২৩ বছর পর ফাইনালে ওঠা কলম্বিয়াকে ১-০ গোলে হারের তিক্ত স্বাদ দিল আলবিসেলেস্তেরা। জয়সূচক একমাত্র গোলটি করেন লাউতারো মার্টিনেজ। এর আগে নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলায় কোনো গোল আসেনি। এতে অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় কোপা আমেরিকার ৪৮তম আসরের ফাইনাল।

এদিকে ৫৮ বছর পেরিয়েও ঘুচল না শিরোপার আক্ষেপ। পরপর দুবার খুব কাছে গিয়েও ইউরোর রুপার কাপটা দেখা হলো না ছুঁয়ে। এবারও খালি হাতে ঘরে ফিরতে হলো বেদনার বিষে নীল হয়ে। ব্রিটিশদের এমনই আক্ষেপে পুড়িয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবলের রাজার আসনে চড়ে বসল স্পেন। স্প্যানিশদের দাপুটে ফুটবলে কার্যত হার মেনেছে থ্রি লায়ন্সরা! ১৬ বছর বয়সি লামিনে ইয়ামাল আর নিকো উইলিয়ামসের মতো তরুণরা নাচিয়ে ছেড়েছেন অভিজ্ঞ হ্যারি কেন-কাইল ওয়াকারদের। ইউরোপের সেরার লড়াইয়ে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। স্প্যানিশদের হয়ে ১টি করে গোল দেন উইলিয়ামস-ওয়ারজাবাল।

কোপা আমেরিকার ফাইনাল বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় শুরুর কথা থাকলেও কলম্বিয়ান দর্শক-সমর্থকদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে প্রায় এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর মাঠে গড়ায় ফাইনাল। এদিন ম্যাচের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনাকে চাপে রাখে কলম্বিয়া। বলের দখল, লক্ষ্যে শট, কর্নার-সবদিক দিয়েই আধিপত্য বজায় রেখেছিল রদ্রিগেজরা। তবে ম্যাচের প্রথম মিনিটে দুর্দান্ত এক সুযোগ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। মন্টিয়েলের ক্রস থেকে পা ছোঁয়ালেও কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা পাননি আলভারেজ।

ম্যাচের ষষ্ঠ মিনিটে প্রথমবার আক্রমণে ওঠে কলম্বিয়ানরা। তবে লুইস ডিয়াজের মাটি কামড়ানো শট ঠেকিয়ে দেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। পরের মিনিটেই বারের পাশ দিয়ে চলে যায় রদ্রিগেজের বাড়ানো বলে করডোভা শট। এরপর ম্যাচের ১৩তম মিনিটে ফের আক্রমণে যায় কলম্বিয়া। রদ্রিগেজের বাড়ানো বলে কুয়েস্টার হেড সহজেই মুঠোবন্দি করেন আর্জেন্টাইন কিপার।

ম্যাচের ৩৩তম মিনিটে দারুণ এক শট নিয়েছিলেন লারমা। তবে আর্জেন্টাইন বাজপাখির হাত ছুঁয়ে মাঠের বাইরে চলে যায় বল। ম্যাচের বাকি সময়ে আর তেমন কোনো সুযোগ তৈরি করতে না পারায় শেষমেষ গোলশূন্য বিরতি নিয়েই মাঠ ছাড়ে দল দুটি।

বিরতি থেকে ফিরেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালায় দল দুটি। ম্যাচের ৪৮তম মিনিটে দারুণ এক সুযোগ পেয়েছিলেন ম্যাক অ্যালিস্টার। তবে তাকে হতাশ করেন কলম্বিয়ার রক্ষণভাগ। ম্যাচের ৫৮তম মিনিটে ডি মারিয়াও সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে তার দুর্দান্ত শট ঠেকিয়ে দেন কামিলো ভার্গাস।

৮ মিনিট পরই দুঃখে ভাসে পুরো হার্ডরক স্টেডিয়াম। চোটে পড়ে ছাড়েন লিওনেল মেসি। এরপর সাইডবেঞ্চে বসেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বিশ্বকাপজয়ী এই অধিনায়ক।

ম্যাচের ৭৫তম মিনিটে জালে বল জড়িয়েছিল আর্জেন্টিনা। জালের নাগাল পেয়েছিলেন মেসির বদলি নামা গঞ্জালেস। তবে অফসাইডের ফাঁদে পড়ে সেটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর ম্যাচের ৮৮তম মিনিটে আরও একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া করে আর্জেন্টিনা। ডি মারিয়ার ক্রসে সামনে বাড়িয়েছিলেন গঞ্জালেস। তবে ঠিকঠাক টাইমিংয়ে সুযোগ লুফে নিতে পারেননি আলভারেজ। এতে নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য থাকে ম্যাচ। অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় ম্যাচ।

কলম্বিয়াকে স্তব্ধ করে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয় অর্ধে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচ জেতানো গোল পাইয়ে দেন লাউতারো মার্টিনেজ। বদলি নেমে তিনি আসরে করেন নিজের পঞ্চম গোল। আর এতে এবার কোপা আমেরিকার সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছেন এই ফরোয়ার্ড। আসরজুড়ে দারুণ ফুটবল উপহার দিয়ে কলম্বিয়ার মিডফিল্ডার হামেস রদ্রিগেজ হয়েছেন আসর সেরা। আর্জেন্টিনার টুর্নামেন্ট জেতায় বড় ভূমিকা রেখে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ হয়েছেন এবারের আসরের সেরা গোলরক্ষক।

টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ছয়টি অ্যাসিস্ট করেন রদ্রিগেজ। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান রাখা শুরুর পর কোপার ইতিহাসে এটাই এক আসরে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের রেকর্ড। ফাইনালে সাফল্য না পেলেও রদ্রিগেজকে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন বল।

কোয়ার্টার ফাইনালে ইকুয়েডরের বিপক্ষে টাইব্রেকারে দুটি শট ঠেকিয়ে দলকে সেমিতে তোলেন এমিলিয়ানো। পুরো আসরে তিনি ছিলেন দারুণ। স্বাভাবিকভাবেই আসর সেরা গোলরক্ষকের গোল্ডেন গস্নাভ পেয়েছেন তিনিই। এ ছাড়া টুর্নামেন্টে ফেয়ার পেস্ন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে রানার্সআপ হওয়া কলম্বিয়া।

ইংল্যান্ডের একমাত্র গোলটি করেন হ্যারি কেনের বদলি হিসেবে নামা কোল পালমার। তবে গোল না দিয়েও ম্যাচ শেষের নায়ক দানি অলমো!

ঠিক ৯০ মিনিটে হতে পারত ২-২। বার্লিনের অলিম্পিয়া পার্কে অলমো গোল লাইনে দাঁড়িয়ে তৈরি করেন 'বার্লিন দেয়াল'। না হয় ম্যাচ যেতে পারত অতিরিক্ত সময়ে। রচিত হতে পারত ভিন্ন গল্প। কিন্তু অলমো দাঁড়ান বাধা হয়ে। রাইসের শক্তিশালী হেড প্রথমে রুখে দেন গোলরক্ষক উনাই সিমন। আবার ফিরতি হেডে বল গোলের দিকে পাঠান গুয়েহি। তার হেড অলমো ফেরান হেড দিয়েই! ফলে আর সমতায় ফিরতে পারেনি ইংল্যান্ড। এর ৪ মিনিট যোগ করা সময়ের পরই চতুর্থবারের মতো ইউরোর চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। এর আগের তিনবার ট্রফি আসে ১৯৬৪, ২০০৮ ও ২০১২ সালে। এদিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোর ফাইনালে হেরে ইতিহাস গড়েছে গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা। গতবার তারা হারে ইতালির বিপক্ষে।

গ্রম্নপ পর্বে ইতালিসহ তারা নকআউটে হারিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দলকে। গ্রম্নপ পর্ব থেকে শুরু করে ফাইনাল পর্যন্ত ৭টি ম্যাচ, সবই জিতেছে স্পেন। বিশ্বকাপসহ ইউরোতে কোনো ইউরোপিয়ান দলের এটাই প্রথম কীর্তি। এ ছাড়া বিশ্বকাপে এমন কীর্তি রয়েছে ব্রাজিলের।

ম্যাচের প্রথমার্ধ ছিল সাদামাটা। দুই দলই মাত্র ১টি করে অন টার্গেট শট নিতে পারে। স্প্যানিশদের দাপট থাকলেও গোল মুখে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিল তারা। বিরতির আগে ইংল্যান্ডের ফোডেন একমাত্র অন টার্গেট শট নিতে পারে।

বিরতি থেকে যেন ভয়ংকর অবতারে ফেরে স্পেন। ১৫ মিনিট ধরে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা করে তোলে ইংল্যান্ড ডিফেন্সকে। বিরতির পর দ্বিতীয় মিনিটেই ইয়ামালের দারুণ পাস আর উইলিয়ামসের নিখুঁত ফিনিশিংয়ে এগিয়ে যায় স্পেন।

৪৭ মিনিটে ডানদিক ইয়ামালকে বল বাড়িয়ে দেন কার্ভাহাল। ১৬ বছর বয়সি ইয়ামাল জায়গা বানিয়ে বাঁ পায়ের ডিফেন্স চেরা পাসে ডানদিক দিয়ে বল দেন উইলিয়ামসকে। নিখুঁত ফিনিশিংয়ে কোনাকুনি শটে উইলিয়ামস বল জড়িয়ে দেন জালে। পিকফোর্ড ঝাঁপ দিলেও পাননি নাগাল। ১-০ গোলে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড।

গোল খেয়ে যেন খেই হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে অলমো-উইলিয়ামস আক্রমণে করেন। অলমোর শট পিকফোর্ড বাঁচালেও উইলিয়ামসের শট বেরিয়ে যায় ডান পোস্টের পাশ দিয়ে। ৬৬ মিনিটে পিকফোর্ডকে একা পেয়েও বাঁ ডানদিকে জোরাল শট নিতে পারেননি ইয়ামাল। রুখে দেন পিকফোর্ড।

মাঝেমধ্যে আক্রমণের চেষ্টা করা ইংল্যান্ড সমতা ফেরায় বদলি নামা পালমারের গোলে। হ্যারি কেনকে তুলে তাকে মাঠে নামান সাউথগেট। ৭০ মিনিটে মাঠে নামার তৃতীয় মিনিটেই গোল! জাতীয় দলের হয়ে দ্বিতীয় গোল! তাও ফাইনালের মঞ্চে।

ডানদিক থেকে এগিয়ে এসে সাকা বল বাড়িয়ে দেন ডি বক্সে থাকা বেলিংহামকে। কিন্তু বক্সে স্প্যানিশ ডিফেন্সের জট দেখে বেলিংহাম বল পাঠিয়ে দেন বাইরে থাকা পালমারকে। ২০ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের মাটি গড়ানো অসাধারণ খিপ্র শটে পালমার বল জড়িয়ে দেন জালে। ৭৩ মিনিটে সমতায় ফেরে ইংল্যান্ড। ম্যাচে ফেরে থ্রি লায়ন্স।

ইংলিশদের ম্যাচে ফেরার উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ থাকেনি। এবার স্প্যানিশদের ত্রাতা ওয়ারজাবাল। নিচু ক্রসে ডি বক্সে বল বাড়িয়ে দেন মার্ক। দৌড়ে এসে স্স্নাইড করে বল জালে জড়িয়ে দেন ওয়ারজাবাল। সুযোগ দেননি পিকফোর্ডকে। ম্যাচ শেষের কয়েক মিনিট আগে ওয়ারজাবালের গোলে হৃদয় ভাঙে ইংলিশদের।

তবুও চেষ্টা থামেনি ইংল্যান্ডের। ৯০ মিনিটে অলমো গোল লাইনে দেয়াল না হয়ে দাঁড়ালে ম্যাচে ফিরতে পারত ইংল্যান্ড। ৪ মিনিট ইনজুরি সময় পেলেও গোলের সুযোগ পায়নি দলটি। শেষ বাঁশি বাজতেই স্প্যানিশদের উৎসবে লাল রঙে রঙিন হয়ে ওঠে বার্লিনের অলিম্পিয়া পার্ক। অন্যদিকে ইংলিশ শিবির রূপ নেয় শ্মশানে, কান্নায় ভেঙে পড়েন সাকা-বেলিংহাম। টানা দ্বিতীয়বার কাছে গিয়েও ট্রফি থেকে দূরে, আর কত?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে