মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্র

কোটাবিরোধী ও ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে দেড় শতাধিক আহত জাবি-চবিতেও হামলা শাবিপ্রবিতে বিক্ষোভ বেরোবিতে আহত ৬
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে আছেন এক তরুণ। ছবিটি সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুলস্নাহ হল এলাকা থেকে তোলা -সংগৃহীত

কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সোমবার বিকালের পর দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়েছে দুই পক্ষ। এতে অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে প্রথম মিছিলটি রাজু ভাস্কর্যের সামনে আসে। পরে সেখানে মিছিল নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এরপর দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে থাকেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে তারা বিভিন্ন সেস্নাগান দিতে থাকেন। আন্দোলনকারীদের দাবি, সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে।

একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে এলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দুই দিকে অবস্থান নিয়ে পরস্পরের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মাস্টার দা সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়ার সামনে অবস্থান নেন। আর বিজয় একাত্তর হলের সামনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

এ সময় কিছুক্ষণ পরপর এক পক্ষের শিক্ষার্থীরা অপর পক্ষকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া দিতে থাকেন। সংঘর্ষের পর উপাচার্যের বাসভবনের সামনের সড়কেও অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। পরে ছাত্রলীগ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এরপর সেখান থেকে আহত শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাদের অধিকাংশের মাথা থেকেই রক্ত ঝরতে দেখা গেছে।

আহত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ইডেন কলেজের ভেতরে ছাত্রলীগের হামলায় ৬ ছাত্রী আহত হন। এছাড়া রাজু ভাস্কর্য, দোয়েল চত্বর, জিয়া হল, শহীদুলস্নাহ হল ও বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। এতে আন্দোলনকারীরা আহত হন।

পরে ঢাকা মেডিকেলের সামনেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই সময় শহীদুলস্নাহ হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে

জড়ান। এ সময় আন্দোলনকারীরা হলের ছাদ থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন।

সংঘর্ষ চলার সময় শহীদুলস্নাহ হলের সামনে দফায় দফায় ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনের ফটকে বিপুল পরিমাণ আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

সংঘর্ষের পর কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পস্ন্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, 'ছাত্রলীগ আমাদের উপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। এই হামলায় অন্তত দুইশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার বলেন, 'আমরা কখনো ভাবি নাই ছাত্রলীগ এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। আমরা নারী শিক্ষার্থীরা অনেকে দৌড়ে পালাতে পারি নাই। ছাত্রলীগের কর্মীরা হেলমেট পরে আমাদের বেধড়ক মারধর করেছে, লাঠিপেটা করেছে। নিজের ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীরা কতটা অসহায়, ছাত্রলীগ আজকে প্রমাণ করল।'

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের নেতাকর্মীদের তারা উসকে দিয়েছেন। আমরা খুব দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছি। তাদের আমরা ৫ মিনিটে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি।'

তিনি বলেন, 'সাধারণ শিক্ষার্থীদের আমরা বলব, আপনারা আন্দোলন থেকে সরে যান। আপনারা ২০ পার্সেন্ট সরে গেলে, দেখা যাবে বাকি ৮০ শতাংশ পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেটা আমরা জানি।'

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শয়ন বলেন, 'ওরা সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, তারা বিএনপির ইশরাকের (বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন) কর্মী। আপনারা গণমাধ্যম অন্ধ হয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী ১০ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ শিবির-ছাত্রদলের অ্যাক্টিভিস্ট।'

নয়ন বলেন, 'জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলকে আমরা যুগে যুগে পরাজিত করেছি। তারা কোনো কিছুই করতে পারে নাই। এবারও কিছু করতে পারবে না।'

সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের তিন থেকে চারজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে মাজহারুল কবির শয়নের ভাষ্য।

ঢাকা মেডিকেলের সামনেও সংঘর্ষ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগ।

সোমবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মারধরের শিকার হয়ে আন্দোলনকারীরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে যান। এ সময় তাদের জরুরি বিভাগ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

তখন কোটাবিরোধীরা সংগঠিত হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেন। পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শহীদুলস্নাহ হলের পাশ থেকে কোটাবিরোধীদেরও ধাওয়া করেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করেন।

পাঁচটি হাত বোমা বিস্ফোরিত হয়। তবে কারা এই ককটেল নিক্ষেপ করেছেন তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।

এদিকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে সংঘর্ষের খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত ছাত্রলীগের সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীরা সেখানে ছুটে যান।

বিকাল সোয়া ৫টার দিকে জরুরি বিভাগের সামনে লাঠিসোঁটা হাতে বেশ কয়েকজন এলে সেখানে হুড়াহুড়ি শুরু হয়। পরে বাঁশি বাজিয়ে আনসার সদস্যরা ছুটে এলে তারা সরে যান। এরপর মেডিকেলের প্রধান ফটক ও জরুরি বিভাগের সামনে বিপুলসংখ্যক আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়।

এরপর হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানসহ ঊর্ধ্বতনরা জরুরি বিভাগের সামনে ছুটে আসেন। সেখানে আসাদুজ্জামান বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শতাধিক আহত মেডিকেলে এসেছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে।'

'যাদের এখন ডিউটি নেই তাদেরও কল করা হয়েছে। আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি বিভাগের সামনে অতিরিক্ত আনসার মোতায়েন করা হয়েছে।'

এ সময় আহতদের সঙ্গে আসা কয়েকজন পরিচালককে বলেন, 'আপনারা কীসের নিরাপত্তা দিচ্ছেন? তারা তো মেডিকেলে এসে আমাদের আহতদের ওপর আবারও হামলা চালাচ্ছে।'

পরিচালক তখন বলেন, 'আমাদের জানা মতে, এখানে আহতদের সঙ্গে যারা আছেন, সবাই আপনাদেরই লোক। তারপরও আপনারা আইডেন্টিফাই করে দিলে আমাদের সুবিধা হয়।'

এরপর তিনি মূল ফটকে অতিরিক্ত আনসার মোতায়েন করেন।

ইডেনে গরম পানি

রাজধানীর ইডেন কলেজ শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি শাহিনুর সুমি আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভে যেতে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ বাধা দেয় এবং মারধর করে। এতে সুমি আহত হন।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, সোমবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর গরম পানি ঢেলে দেন এবং মারধর করেন। এতে সুমিসহ কয়েকজন আহত হন। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে। হামলায় আহত হয়েছেন ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সায়মা আফরোজ, ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি শাহিনুর সুমি, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া সাইনা, অর্থ সম্পাদক সানজিদা হক এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের ঢাকা মহানগরের সংগঠক স্কাইয়াসহ অনেকে।

প্রশাসনের ৫ নির্দেশনা

ক্যাম্পাসে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও হলে বহিরাগত অবস্থানে নিষেধাজ্ঞাসহ ৫ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। সে অনুযায়ী নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

সোমবার বিকালে হল প্রভোস্টদের নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

নির্দেশনাগুলো হলো- শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব হলে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবেন; প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে সার্বক্ষণিকভাবে হলে অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন; হলসমূহে কোনো বহিরাগত অবস্থান করতে পারবেন না; যেকোনো ধরনের গুজব ও অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে; সকলকে নাশকতামূলক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বলা যাচ্ছে।

কেউ নাশকতামূলক কাজে জড়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এবং বিভিন্ন হল ও হোস্টেলসমূহের প্রাধ্যক্ষ এবং ওয়ার্ডবৃন্দ।

কী বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী?

২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এর মধ্যে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে।

বক্তব্যের একপর্যায়ে সরকারপ্রধান বলেন, 'কোটা আন্দোলন করার আগে তো তোদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যে- কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা (চাকরি) পাবে?

তিনি বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে, নিজের পরিবার সংসার সব বাদ দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, খেয়ে না খেয়ে, কাদা মাটিতে রোদ বৃষ্টি ঝড় সব উপেক্ষা করে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় এনে দিয়েছিল বলেই সবাই উচ্চপদে আসীন, আজকে বড় গলায় কথা বলতে পারছে। নইলে পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে মরতে হতো।'

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে 'মর্মাহত' হয়ে রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষালয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ দেখান; যেখানে সেস্নাগান দেওয়া হয়, 'তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছ, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার'।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুলস্নাহ বলেন, 'স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই রাজাকারকে সবাই ঘৃণা করে, আমাদের রাজাকার বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ২ পারসেন্ট ছাড়া বাকি ৯৮ পারসেন্ট রাজাকার? এটা ছাত্রদের আহত করেছে।'

মিছিলে অংশ নেওয়া হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের কথা আমরা কখনোই প্রত্যাশা করিনি। তিনি কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেছেন, এর চেয়ে জঘন্য কথা আর কী হতে পারে?'

'হাজার হাজার শিক্ষার্থী কোটা আন্দোলনে স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছেন। সবাই কি রাজাকারের নাতিপুতি?'

রাত ১টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চলে যাওয়ার পর টিএসসি এলাকায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খানসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের দেখা যায়। পরে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রলীগ।

মিছিলে 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা' প্রভৃতি সেস্নাগান দেওয়া হয়। রাত ৩টার পর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্রলীগ সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে সোমবার বিকাল ৩টায় রাজু ভাস্কর্যে প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।

তিনি বলেন, 'বাঙালির মহান স্বাধীনতাকে কটাক্ষ, একাত্তরের ঘৃণিত গণহত্যাকারী রাজাকারদের প্রতি সাফাই এবং আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীলতা তৈরির প্রতিবাদে এ সমাবেশ হবে।'

শিক্ষার্থীদের সমাবেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা অনুযায়ী সোমবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরাও সমাবেশে অংশ নেন।

এ সময় তারা নিজেদের দাবির পক্ষে সেস্নাগান, প্রতিবাদী গান ও কবিতায় কর্মসূচি চালিয়ে যান।

সমাবেশে শিক্ষার্থীরা 'কে বলেছে রাজাকার, ধিক্কার ধিক্কার', 'তুমি নও, আমি নই, রাজাকার রাজাকার', 'আমি কেন রাজাকার, জবাব চাই জবাব চাই', 'প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে', 'লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না' ইত্যাদি সেস্নাগান দেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম সমাবেশে বলেন, 'গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের উদ্দেশ্য করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যা বলেছেন, তা আমাদেরকে আশাহত করেছে। আমাদের দাবির বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থা রেখেছিলাম। কিন্তু গতকাল তিনি যা বলেছেন, এতে আমাদের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা চাই, অবিলম্বে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন।'

তিনি বলেন, 'আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের যেভাবেই বেস্নম দেওয়া হোক না কেন, আমাদের উদ্দেশ্য একটিই, সেটা হলো কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার। এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।'

তিনি বলেন, 'উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার কোনো বিকল্প নাই। ৫৬ শতাংশ কোটা উন্নত বাংলাদেশের সঙ্গে যায় না। ৫৬ শতাংশ কোটা কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না।'

কী নিয়ে আন্দোলন

২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছে। তারা প্রথমে সেই পরিপত্র ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার দাবি জানালেও পরে সংস্কারের দাবি তুলেছে।

গত সপ্তাহে মঙ্গলবার বাদ দিয়ে প্রতিটি কর্মদিবসেই তারা বাংলা বস্নকেড নামে অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। বুধবার পর্যন্ত তারা নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালন করলেও বৃহস্পতিবার থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়, একাধিক এলাকায় বাধাও দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন না করে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার এবং আদালতে এসে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।

তবে শিক্ষার্থীরা সংসদ অধিবেশন ডেকে কোটার বিষয়ে ফয়সালা চাইছেন, আর ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন।

রোববার শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মেনে নিতে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেন। এতে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন আন্দোলনকারীরা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন।

পরে বিকালে প্রধানমন্ত্রী চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'কোটার বিষয়টি ফয়সালা হবে আদালতেই। আর রাস্তায় ধ্বংসাত্মক কিছু হলে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে