দেশের বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে ক্রমেই বাড়ছে দেনা পরিশোধের চাপ। এ ছাড়াও গত তিন অর্থবছরে এ খাতে বেড়েছে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা। অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে জ্বালানি আমদানি কিংবা বকেয়া পরিশোধ সব কিছুর দায় মেটাতে হচ্ছে ঋণের অর্থে। অথচ জ্বালানি সরবরাহ বাবদ বকেয়া বিল তুলতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলা। যার পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এলএনজি, জ্বালানি তেল ও বিদু্যৎ আমদানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বাবদ বকেয়া পাওনা ১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের ছুঁয়েছে। গত ৭ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ২৩০ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ৭৮০ মিলিয়ন ডলার বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, পেট্রোবাংলার মোট দেনার ৪৫০ মিলিয়ন ডলার এলএনজি আমদানি বাবদ। শেভরন দেশের ভেতরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা গ্যাস সরবরাহের জন্য সংস্থাটির কাছে ২৫০ মিলিয়ন ডলার পাবে। অন্যদিকে ঋণদাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) পাবে ৮০ মিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডলার
সংকটের জন্য বিপিসি ও পেট্রোবাংলার বকেয়া তৈরি হয়েছে। যদিও এ সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে না। ফলে বকেয়া দেনার জন্য দিতে হচ্ছে জরিমানাও।
বিদু্যৎ বিভাগের সূত্র অনুসারে, ভারতের আদানি গ্রম্নপ বিদু্যৎ সরবরাহ বাবদ ৬শ' মিলিয়ন ডলার পাবে। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সরবরাহকৃত বিদু্যতের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার বিল বকেয়া রয়েছে। এর বাইরে কয়লা আমদানির বিলও বকেয়া আছে বলে জ্বালানি বিভাগসূত্রে জানা গেছে।
তবে জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম বলেন, 'এ বছর বিদু্যৎ খাতে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে এবং স্পট মার্কেটে দাম কমার কারণে এলএনজি সরবরাহ বেড়েছে। এতে জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কমেছে। এর ফলে এলএনজি আমদানির বিল বকেয়া বেড়েছে। এটি স্বাভাবিক এবং আমরা এটি মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি।'
অন্যদিকে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যায়ক্রমে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে। তবে এবার বকেয়ার পরিমাণ একটু বেশি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সরবরাহ শুরু করলে বকেয়ার পরিমাণ কমে যাবে।
এদিকে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য সোনালী ব্যাংককে ডলার দেওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে এ খাতে ডলার সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮.৮০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং ১৩.১৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। পেট্রোবাংলা চলতি বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে ২১টি এলএনজি কার্গো কিনেছে। একই সময়ে রাষ্ট্রীয় চুক্তির অধীনে কাতার ও ওমান থেকে অতিরিক্ত ২১টি কার্গো আমদানি করা হয়েছে।
বিভিন্ন সংস্থার কাছে পেট্রোবাংলার বকেয়া
এদিকে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর কাছে জ্বালানি বাবদ পাওনা বিল তুলতে পারছে না জ্বালানি বিভাগ। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিদু্যৎকেন্দ্র ও সার কারখানাগুলোর কাছে পেট্রোবাংলার অধীন ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এখন এই বিপুল বকেয়া পাওনা আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার ছয় কোম্পানির কাছে যে বকেয়া পড়েছে, এর মধ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বকেয়া বিলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এরপর সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিল গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের, ৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার বেশি।
অন্যদিকে উৎপাদকদের কাছ থেকে বিদু্যৎ কিনে বিতরণকারী কোম্পানির মাধ্যমে বিদু্যৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। পেট্রোবাংলার কাছ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদু্যৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বিদু্যৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় গ্যাসও কেনে বিপিডিবি। বিপিডিবির কাছে পেট্রোবাংলা পাবে ৮ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।
হরিপুর পাওয়ার, মেঘনাঘাট পাওয়ার, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার, রিজেন্ট এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার, ইউনাইটেড পাওয়ার ও সামিট বিবিয়ানা-২-সহ বেসরকারি বিদু্যৎকেন্দ্রের কাছে পেট্রোবাংলার মোট বকেয়া পাওনা ১৩ হাজার ৫৯৩.৪১ কোটি টাকা।
এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন-এর (বিসিআইসি) কাছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পাওনা ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। বিসিআইসি সার কারখানা চালানোর জন্য গ্যাস কেনে। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর থেকে বাড়তি দাম পরিশোধ করেনি বিসিআইসি। এতে দেনার অঙ্ক দিন দিন বড় হচ্ছে।
গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করে থাকে পেট্রোবাংলা। বিসিআইসির আওতাধীন সার কারখানাগুলোর কাছে পেট্রোবাংলার মোট পাওনার পরিমাণ ৬৪২.৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে যমুনা ফার্টিলাইজারের কাছে পাওনা ৪২৩.০৮ কোটি টাকা এবং ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া কারখানার কাছে পাওনার পরিমাণ ২০১.৪৭ কোটি টাকা।
জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানির কাছে ৭৪৫.৭৫ কোটি টাকা, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজারের কাছে ৪৯১.৩১ কোটি টাকা এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি চিটাগং ইউরিয়া কারখানার কাছে পাবে ৩৮৮.৪২ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলা বলছে, বিসিআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে বারবার দেনার টাকা পরিশোধের বিষয়ে বলা হলেও তারা এই টাকা পরিশোধ করছে না। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টি এখন এমন অবস্থায় যাচ্ছে যে বাধ্য হয়েই সার কারখানাগুলোর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।