সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটার বিরোধিতায় আন্দোলনের মধ্যে সব পক্ষকে চার সপ্তাহ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, কোটা নিয়ে এখন কোনো কথা বলা যাবে না। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আপিল বিভাগ আবার বিষয়টি শুনবে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৭ আগস্ট।
বুধবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ পৃথক দুটি আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে স্থিতাবস্থা জারির এ আদেশ দেন।
প্রধান বিচারপতি তার আদেশের সঙ্গে তিনটি পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিনি ক্লাসে ফিরে যেতে বলেন। শিক্ষকদের বলেন ছাত্রদের বুঝিয়ে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে। আর সংক্ষুব্ধদের উদ্দেশে বলেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি মামলায় যুক্ত হতে চান, আইনজীবীর মাধ্যমে যুক্ত হতে পারবেন, শুনানি হলে তখন তাদের কথাও শোনা হবে।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপিল বিভাগ প্রয়োজনে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের রায় সংশোধন কিংবা এ বিষয়টি নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিও করতে পারে।
আপিলকারী রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, আপিলকারী দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী।
এদিকে অন্তর্র্বর্তীকালীন এই আদেশের পর শিক্ষার্থীদের রাস্তায় আন্দোলন করার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, 'শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আমি বলব, আপনাদের আর আন্দোলন করার যৌক্তিক কারণ নেই। যেহেতু আদালত একটি অন্তর্র্বর্তী আদেশ দিয়েছেন। আপনারা সবাই রাস্তা ছেড়ে (দেন)। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবেন না, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে
মানুষের সমস্যা হয়। মানুষের সমস্যা হলে রাষ্ট্রকে দেখতে হয়। এ কথাগুলো বিবেচনা করে অবশ্যই আপনারা আপনাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করুন।'
শুনানিতে আদালত কী বলেছেন-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেন, আদালত একটি কথা বলেছেন, কোনোভাবেই রাস্তায় আন্দোলন করে তো আদালতের রায় পরিবর্তন করা যায় না। আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে কারও যদি বক্তব্য থাকে, সেক্ষেত্রে আদালতে আসতে হবে। আদালত বলেছেন, আদালতে আসতে।
প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে কী বলেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যেতে বলেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা তাদের ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসে নিয়ে যাবেন, বোঝাবেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন পরে বলেন, 'আপিল বিভাগ সাবজেক্ট ম্যাটারে স্থিতাবস্থা জারি করেছে। ফলে হাইকোর্টের রায়ের আগে যেমন ছিল, সব তেমন থাকবে। তার আগে কোটা বাতিল-সংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র কার্যকর ছিল, সেটা থাকবে।'
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল থাকবে বলে ওই পরিপত্রে বলা হয়।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
গত ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।
গত ৪ জুলাই এ বিষয়ে আপিল বিভাগে শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে রিটকারীর পক্ষে সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায় আপাতত বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
এদিকে গত মঙ্গলবার দুই শিক্ষার্থীও হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য অনুমতি চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেন। চেম্বার জজ বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম তাদের হলফনামা করার অনুমতি দেন এবং বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য বুধবারের কার্যতালিকায় রাখেন।
হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা। ১ জুলাই থেকে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ব্যানারে তারা কোটা বাতিলসহ চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন।
এর অংশ হিসেবে রবি ও সোমবার ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে তারা 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি পালন করেন। তাদের অবরোধের কারণে শহরজুড়ে ব্যাপক যানজটে নাকাল হতে হয় নাগরিকদের।
'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ব্যানারে এই আন্দোলন সমন্বয়ের জন্য ৬৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন আন্দোলনকারীরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা চার দফা দাবিকে এক দফায় নামিয়ে আনেন।
এখন তাদের দাবি হলো- সব গ্রেডে সব ধরনের 'অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক' কোটা বাতিল করে সংবিধানে উলিস্নখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে 'নূ্যনতম পর্যায়ে' এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে?
এই দাবিতে বুধবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশে বাংলা বস্নকেড কর্মসূচির ঘোষণা আসে ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে।
সেই ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার সকাল থেকে আন্দোলনকারীরা ঢাকার বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের অবরোধের কারণে শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব মোড়, মৎস্যভবন মোড়, জিরো পয়েন্ট, মহাখালীর আমতলীতসহ বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক ও রেলপথও তারা অবরোধ করেন।
তাদের এই আন্দোলনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোটা নিয়ে স্থিতাবস্থা জারির আদেশ আসে। তবে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, 'আইন করে কোটা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত' তাদের আন্দোলন চলবে।
বিএনপিসহ সমমনা বিভিন্ন দল শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের এ আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে বলা হচ্ছে 'অযৌক্তিক'।
সরকারের কাছে সমাধান
চান আন্দোলনকারীরা
এদিকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটার বিষয়ে আপিল বিভাগের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারীরা বলেছেন, আদালতের সঙ্গে তাদের আজকের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা সরকারের কাছে কোটা-সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান চাইছেন। যৌক্তিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না।
কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আজ (বুধবার) আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেওয়া হয়।
আপিল বিভাগের আদেশের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আদালতের সঙ্গে আমাদের আজকের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা মূলত নির্বাহী বিভাগের কাছেই কোটা-সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান চাইছি। এক দফা দাবি। এটি আদালতের এখতিয়ার নয়। এটি একমাত্র নির্বাহী বিভাগই পূরণ করতে পারবে। সরকারের কাছ থেকেই আমরা সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করছি।'
শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচিতে থাকা এই আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুলস্নাহ বলেন, 'এই আদেশের মাধ্যমে সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করা হয়েছে। আমরা আশাহত হয়েছি। কিন্তু দমে যাইনি। নির্বাহী বিভাগ থেকে কমিশন গঠন করে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সমাধান না করা পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।'