টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে চলতি বছর দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে। এর মধ্যে বন্যাকবলিত ৯ জেলার এক হাজার ৫শ'র বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। জেলাগুলো হলো সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ। ফলে শিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বন্যাকবলিত জেলার শিক্ষার্থীরা। আর অভিভাবকরা বলছেন, সর্বনাশা বন্যার কারণে ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে তাদের সন্তানরা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বন্যায় উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কলেজসহ ৩৪১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ৩টি বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলমান বন্যায় চর দ্বীপচর ও নিম্নাঞ্চলে থাকা ৩৪১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যায় পস্নাবিত হওয়ার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পাঠদানে অনুপযোগী হওয়ায় গত ৩ জুলাই থেকে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নবেজ উদ্দিন বলেন, 'জেলায় বন্যায় পস্নাবিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখা ২৫৩টি। এর মধ্যে ২২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।'
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুল হক বলেন, 'জেলায় চলতি বন্যায় ৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৬টি মাদ্রাসা ও ৬টি কলেজের পাঠদান কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বপন কুমার রায় চৌধুরী জানিয়েছেন, জেলার ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। এর মধ্যে ১৪টি বিদ্যালয়ে পাঠদান প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিন উপজেলার ৫৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পস্নাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দিতে ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৌহিদুর রহমান জানান, সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে এবং পানি প্রবেশ করেছে। এরকম ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপাতত পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪০টি এবং বাকি ৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
হলে ফের পাঠদান শুরু হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
জামালপুর জেলার ৩৫৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানি বিদ্যালয়ে প্রবেশ করায় এ পর্যন্ত জেলায় ২৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জে ৮১টি, বকশীগঞ্জে ৩টি, ইসলামপুরে ৩৮টি, মাদারগঞ্জে ৮১টি, সরিষাবাড়ীতে ১৯টি ও মেলান্দহে ৩৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানি প্রবেশ করায় জেলায় এ পর্যন্ত ৮৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জে ২৫টি, বকশীগঞ্জে ১৫টি, ইসলামপুরে ২৯টি, মাদারগঞ্জে ৯টি সরিষাবাড়ীতে ৯টি ও মেলান্দহে ১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে পানি প্রবেশ করেছে সেসব প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়ন পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা মতো পরবর্তী সময় সেই পরীক্ষা নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জে ৭৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি) রোজিনা আক্তার বলেন, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ এবং ভবনের অভ্যন্তরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় রোববার সকাল পর্যন্ত জেলায় মোট ৭৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৬১টি প্রাথমিক এবং ১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগম ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, বন্যার প্রভাবে এ পর্যন্ত জেলার ১৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাদ্রাসাসহ ২২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজ এবং ১১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বন্যার কারণে ফুলছড়ি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে পরীক্ষার্থীদের ভরতখালি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবার কয়েক দফা বন্যার কারণে জেলায় ৩৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে ৭৮টি। এছাড়া কয়েকটি কলেজে পানি উঠে যাওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, ১ হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯৮টিতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট সদর উপজেলায় ৩৭টি, বিশ্বনাথে ২টি, বালাগঞ্জে ৫৫টি, ফেঞ্চুগঞ্জে ৩২টি, গোলাপগঞ্জে ২৭টি, বিয়ানীবাজারে ৫৪টি, জকিগঞ্জে ২৩টি, কানাইঘাটে ৪টি, জৈন্তাপুরে ৩টি, গোয়াইনঘাটে ২টি, কোম্পানীগঞ্জে ৬৫টি, দক্ষিণ সুরমায় ২২টি ও ওসমানীনগরে ৭২টি বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া ৭৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
বন্ধ ঘোষিত ৩৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর বাকিগুলো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খুরশেদ আলম জানিয়েছেন, জেলার বন্যাকবলিত পাঁচটি উপজেলার ৯৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ আছে। পাশাপাশি কিছু বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়নি।
সুনামগঞ্জে বন্যায় রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলে জেলার ২৯৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার বেশিরভাগ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত রেখেছে মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যার কারণে জেলার ২৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকার ৫৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা মিলে মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুনামগঞ্জের দুলাল মিয়া নামের এক অভিভাবক জানান, বন্যার কারণে রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি। পানির কারণে বইপত্র নষ্ট হয়েছে। শিশুদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন্যার কারণে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষান্মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। তবে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা বৃষ্টি সঙ্গী করে গত জুন মাসের ৩০ তারিখ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। এরই মাঝে দেশে হানা দিয়েছে বন্যা। বন্যার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের পড়াশোনা। বন্যার পানিতে বইপত্র নষ্ট হওয়ায় বিপাকে রয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী।