রোববার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১
পিএসসির প্রশ্নফাঁস

আবেদ আলীসহ ছয় আসামির দায় স্বীকার

পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১১ জন কারাগারে পাঁচ জন বরখাস্ত ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ
যাযাদি রিপোর্ট
  ১০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
সৈয়দ আবেদ আলী

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলীসহ গ্রেপ্তার ১৭ আসামির ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয় বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

আসামিরা হলেন- সৈয়দ আবেদ আলী (৫২), মো. খলিলুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম (৪১), ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল (৩৫), মো. সাখাওয়াত হোসেন (৩৪), সায়েম হোসেন ও বেকার যুবক লিটন সরকার। দুপুরে তাদের আদালতে হাজির করা হয়।

এদিকে, বিসিএসসহ বিভিন্ন

চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। মঙ্গলবার পিএসসির জারি করা পৃথক পাঁচটি প্রজ্ঞাপনে তাদের বরখাস্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জারি করা এসব প্রজ্ঞাপনে সই করেছেন পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন।

সাময়িক বরখাস্তরা হলেন-পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর, উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।

অন্যদিকে, বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদের মধ্যে পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও রয়েছেন।

মঙ্গলবার তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইউ) একটি সূত্র।

বিএফআইউ সূত্র জানায়, ব্যাংক হিসাব জব্দ সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকবে বলেও চিঠিতে উলেস্নখ করা হয়েছে।

এর আগে প্রশ্ন ফাঁসকান্ডের ১৭ আসামির মধ্যে সাতজনের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করা হয়েছে। এ আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। দুপুর আড়াইটার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আসামিদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারকের খাস কামরায় তোলা হয়।

একই তদন্ত কর্মকর্তা অপর আসামিদের মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আসামিপক্ষে জামিন আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এই তালিকায় রয়েছেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান ও আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।

এদিকে প্রশ্নফাঁসে জড়িত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার বিষয়টিই এখন 'টক অব দ্য কান্ট্রি।' তাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আলোচিত আবেদ আলী প্রশ্নফাঁস এবং এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কী তথ্য দিয়েছেন তা জানতে সবাই উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। তবে মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত আবেদ আলীসহ ৭ আসামির কারোর স্বীকারোক্তি সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। মামলা দায়ের হয়েছে। আদালতে ৭ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। তিনি আরও বলেন, এ চক্রের সঙ্গে যারই নাম আসবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে।'

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দুই যুগ ধরে বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিকসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে চক্রটি। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসও বাদ যায়নি এদের খপ্পর থেকে। একটি দুটি তো নয়, ২৪তম বিসিএস থেকে ৩৩তম পর্যন্ত প্রায় ৩০টি ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের তথ্য পাওয়া গেছে।

চক্রটির অন্যতম মূল হোতা পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, 'উপপরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। তিনি বড় কর্মকর্তাদের ট্রাঙ্ক থেকে পরীক্ষার আগের দিন আমাকে প্রশ্ন সরবরাহ করেন।' তিনি আরও জানিয়েছেন, 'আমি এটাও জানি ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।'

আবেদ আলীর যত সম্পদ

সৈয়দ আবেদ আলী অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ঢাকায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপেস্নক্স ভবন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী এসব তথ্য জানিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সিআইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, আবেদ আলীর আরও সম্পদ রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে সোমবার রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে সৈয়দ আবেদ আলী ও তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় পিএসসির দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ আরও ১৫ জনকে। মঙ্গলবার পল্টন থানায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করেছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা। আবেদ আলীর ছেলে সোহানুর রহমান ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। সোমবার ওই সংগঠন থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর থানার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের বিসমিলস্নাহ টাওয়ার নামে একটি ৯ তলা ভবনে সপরিবারে আবেদ আলী থাকেন। ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সোহেল খান জানান, আবেদ আলী ৫ম তলার একটি ফ্ল্যাটে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন। তবে তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে ওই এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ভবনটিতে আবেদ আলীর পাঁচটি ফ্ল্যাট ছিল। কয়েক মাস আগে দুটি ফ্ল্যাট তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন রয়েছে তিনটি।

সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, শেওড়াপাড়ার ভবনটির পঞ্চম তলায় দুটি ও চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। ব্যাংকে তার নগদ টাকা রয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী সিআইডি কর্মকর্তাদের বলেন, গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকের কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করেছেন এবং তাদের চাকরিও হয়েছে।

এদিকে পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দ আবেদ আলী পিএসসিতে চাকরি নিয়েছিলেন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। তার বাড়ি মাদারীপুরে। তবে তিনি ঠিকানা দিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের। দুই বছর আগে থেকে আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসারে তার নিজ এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। তিনি নতুন উপজেলা ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। এই নির্বাচনের তফসিল এখনো হয়নি। তবে তিনি প্রার্থী হতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালাচ্ছেন। এলাকায় তিনি দামি গাড়িতে চড়ে গণসংযোগ করেন।

কারাগারে যাওয়া আসামিরা

সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান।

পিএসসির তদন্ত কমিটি

একটি চক্র প্রায় এক যুগ ধরে পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত বলে রোববার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচারিত হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে। সেখান ওই চক্রের ছয়জনের ছবি প্রকাশ করা হয়।

এ পরিস্থিতিতে প্রশ্নফাঁস নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে সরকারি কর্ম কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন সোমবার রাতে এ কমিটি করে দেন বলে পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এসএম মতিউর রহমান জানান। পিএসসির যুগ্মসচিব আব্দুল আলীম খানকে আহ্বায়ক এবং পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল হককে সদস্য সচিব করে গঠিত এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন পিএসসির পরিচালক দিলাওয়েজ দুরদানা। তবে কতদিনের মধ্যে এই কমিটি প্রতিবেদন দেবে তা জানাতে পারেননি মতিউর রহমান।

এর আগে সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে পিএসসি বলে, কমিশনের কারো বিরুদ্ধে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, প্রতারণা বা অন্য কোনো অবৈধ কার্যক্রমে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেলে পরীক্ষা বাতিল

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের দশম গ্রেডের ১১ ক্যাটাগরির ৫১৬টি উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলে এ পরীক্ষা বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছেন পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন। মঙ্গলবার সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। কমিটির সুপারিশ পেলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে।

এদিকে পিএসসির অধীনে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের দশম গ্রেডের ১১ ক্যাটাগরির ৫১৬টি উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিএসসির সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন চাকরিপ্রার্থীরা।

অন্যদিকে ১২ বছরে কতগুলো প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এবং ওইসব পরীক্ষার ব্যাপারে কী হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, '১২ বছর ধরে অনেক পরীক্ষা হয়েছে। সেসব পরীক্ষার কথা যদি এখন ওঠে তাহলে সেগুলো নিয়ে কতটা কী হবে আমি বুঝতে পারছি না।'

পিএসসি চেয়ারম্যানের ভাষ্য, কোনো অপরাধ যদি প্রমাণ হয় এবং সেটা যদি পিএসসির এখতিয়ারভুক্ত হয় তাহলে আইনে যা ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা পিএসসি নেবে।

তিনি বলেন, 'যখনই কোনো পরীক্ষা হয়, তখন সেখানে কোনো অনিয়ম হলে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে হোক বা পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমে হোক বা বিভিন্নভাবে (অভিযোগ) আসে। ১২ বছর আগের পরীক্ষা নিয়ে এতদিন পরে প্রমাণ কীভাবে হবে?'

তবে, পিএসসি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে এবং ১২ বছর আগের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নিয়েও এই তদন্ত কমিটি কাজ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'পরিপূর্ণ বিষয়টিই আমাদের তদন্তের মধ্যে আছে। আমাদের তদন্তের প্রতিবেদনে পরিপূর্ণ বিষয়টি আনা হচ্ছে হুবহু কোট-আনকোট করে।'

পিএসসির সাবেক গাড়িচালকের প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় প্রকাশ্যে আসায় পিএসসি বিব্রত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেকোনো ঘটনা, সেটা যদি পিএসসিকেন্দ্রিক হয় তাহলে সেটা আমাদের জন্য কষ্টদায়ক।'

পিএসসি কীভাবে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করে এবং সেখানে তৈরিকৃত ছয় সেট প্রশ্ন থেকে কীভাবে একটি সেট চূড়ান্ত করা হয় সেই বর্ণনা দেন সোহরাব হোসাইন।

তাকে প্রশ্ন করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্নফাঁসের সুযোগ নেই, এই দাবি তিনি করছেন কি না। উত্তরে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, 'আমি এটা বলতে চাই না। কারণ, এটা এককভাবে কেউ করে না, অনেক জনের সমন্বয়ে করে। কিন্তু (প্রশ্নফাঁস করা) ভীষণ কঠিন। প্রশ্নফাঁস করলে ছয় সেট ফাঁস করতে হবে। ছয় সেট মানে এক হাজার ২০০ প্রশ্ন।'

তিনি বলেন, 'লটারিতে ছয় সেট থেকে কোনো একটা সেট আসে। লটারিতে কোনটা আসবে, সেটা একমাত্র আলস্নাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না।' ওইগুলো (আগের পরীক্ষা) সম্পর্কে গভীর চিন্তা করতে হবে এবং এটা আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে পরে কি না সেটাও দেখতে হবে। এখতিয়ারের বাইরে হলে আমরা কী করবো।'

তার দাবি, 'যদি (প্রশ্নফাঁস) হয়েও থাকে, তাহলে আমরা কাউকে ছাড়ব না। এমনকি আমারও যদি কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে আমিও শাস্তির বাইরে যাব না। এটা আমি নিশ্চিত করতে পারি।'

প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করেছেন আবেদ আলী। তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আপনারা জানেন, আগে এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে অনেকে চাকরি হারিয়েছে এবং আবার অনেকে ফিরে এসেছেন। যারা ফিরে এসেছেন তাদের অনেকে কোর্টের আদেশে ফিরে এসেছেন, আবার অনেকে অন্যভাবে ফিরেছেন। আমরা আসলে সবসময় প্রস্তুত সরকারের বিধান বাস্তবায়নে।'

যেসব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে, সেগুলো প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেসব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে বলতে একমাত্র সর্বশেষ পরীক্ষা পাঁচ তারিখের সেই পরীক্ষাটাই আসবে। কারণ এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই সব হচ্ছে। সেই পরীক্ষার প্রশ্ন যদি ফাঁস হয়, তাহলে পরীক্ষা বাতিল হবে সেই সিদ্ধান্ত কমিশন নেবে।'

পিএসসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'এই প্রতিষ্ঠানটি (পিএসসি) রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দিকে লাখো যুবক তাকিয়ে আছে। এই প্রতিষ্ঠানে কোনো তদবির পর্যন্ত হয় না। একটিও না। সেই প্রতিষ্ঠানটি যাতে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেরকম একটা পর্যায় রাখতে আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানে, এমনকি আমারও যদি কোনো অনিয়মে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, আমাকেও চাকরিচু্যত করা হবে।'

'অনেক সময় বোর্ডের প্রশ্নের মতো দেখতে এমন প্রশ্ন বিক্রি করে একটা চক্র টাকা আয় করে। সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে যে এখানেও সেটাই হয়েছে কি না। তেমন হলে এজেন্সি সেটা দেখবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সবার উপরে। আমি না থাকতে পারি, আপনি না থাকতে পারেন, কিন্তু এটি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান অযথা যেন এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও বিশ্বস্ততা নষ্ট না হয়,' যোগ করেন তিনি।

মাদারীপুর স্টাফ রিপোর্টার জানান, সৈয়দ আবেদ আলী জীবন। তিনি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) গাড়িচালক। জীবিকার তাগিদে মাত্র ৫-৬ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্নের শহর ঢাকায়। কিন্তু স্বপ্ন কী এত সহজেই ধরা দেয়! শুরু করেন কুলির কাজ দিয়ে। এরপর গাড়ি চালানো শিখে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে চাকরি নেন পিএসসিতে। আস্তে আস্তে পেয়ে বসে লোভ-লালসায়। এক সময় জড়িয়ে পড়েন পিএসসির প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক তার ঝুলিতে জমতে থাকে বিপুল সম্পদ। সঙ্গে ক্ষমতাও। এরপর হতে চেয়েছিলেন জনপ্রতিনিধিও! সেই লক্ষ্য নিয়েই ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছিলেন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা।

তবে বিধি বাম! সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে উঠে আসে ভয়ংকর তথ্য। প্রায় একযুগ আগে থেকেই তিনি বিপিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ঘটনায় সোমবার পিএসসির দুই উপপরিচালক ও আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। আবেদ আলীর এমন কুকর্ম মানতে নারাজ এলাকাবাসী। তারা হতবাক!

আবেদ আলীর বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামে। সেই গ্রামে রয়েছে তার আলিশান বাড়ি। সেখানে এখন তালা ঝুলছে।

স্থানীয়রা জানান, এলাকায় আবেদ আলী দানবীর নামে খ্যাত। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিজ বাড়ির আশপাশে মানুষের পুরনো বাড়ি, ফসলিজমি কিনেছেন শত শত কোটি টাকার।

জানা গেছে, বোতলা গ্রামে তিনি তার নিজ নামে গড়ে তুলেছে বিলাসবহুল আলিশান বাড়ি ও মসজিদসহ নানা সম্পদের পাহাড়। অবৈধ টাকা দিয়ে স্থানীয় মানুষের পুরনো বাড়ি, ফসলি জমি কিনেছেন শত শত কোটি টাকার। নিজ বাড়ির পাশেই সরকারি জমি দখল করে তৈরি করেছেন গরুর খামার। তিনি অবৈধ টাকার মালিক হয়ে পরিবার নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ফ্লাটসহ একাধিক ভবন। সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা তৈরি করেছেন সান মেরিনা নামে বিলাসবহুল হোটেল। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন একাধিক দামি বিলাসবহুল গাড়ি। নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার শত শত শতাংশ জমি। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন দপ্তরে করতেন দালালি। দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজ ফেসবুক আইডিতে করেছেন ভাইরাল এবং সেই ছবি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখিয়ে সুবিধা নেওয়ারও রয়েছে একাধিক অভিযোগ। আবেদ আলীর ছেলে ঢাকা-উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ সোহান রহমান। তিনি কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করছেন। সবশেষ উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন আবেদ আলী।

কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, ছোটবেলায় আবেদ আলীর পরিবারের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। দুবেলা-দুমুঠো ভাত খেতে পারত না তার পরিবারের সদস্যরা। অভাবের কারণে আবেদ আলী ৫-৬ বছর বয়সেই ঢাকা চলে যান। এরপর আবেদ কুলি গিরি করেছেন, রিকশা চালানোসহ শ্রমিকের কাজ করেছেন। পরে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করেছেন সচিবালয়ে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করতেন। এলাকার মানুষকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। বাড়িতে নির্মাণ করেছেন সুন্দর একটি মসজিদ। এলাকাবাসী আবেদকে দানশীল ব্যক্তি হিসেবে জেনে। আগামীতে ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রশ্ন ফাঁস ও অবৈধ সম্পদের কথা শুনে আমরা অবাক।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, ইতোমধ্যে আমরা আবেদ আলীকে নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু করেছি বিভিন্ন দপ্তরে। তার বৈধ কোনো সম্পদ আছে কিনা এবং সেগুলোর সঠিকভাবে ক্রয় ও কর দেওয়া হয়েছে কিনা তার খবর নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আদালত থেকে যদি তার বিষয়ে কোনো আদেশ আসে তা হলে আমরা তা নিয়ম অনুযায়ী বাস্তবায়ন করব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে