বিএনপির চার মহানগর কমিটি ঘোষণায় উচ্ছ্বাস-ক্ষোভ

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৪, ০১:০৯

যাযাদি রিপোর্ট
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ বিএনপিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ চার মহানগরে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ব্যর্থতার কারণে বিলুপ্ত করা কমিটিগুলোর নতুন নেতৃত্বে পুরনোদেরও রেখেছে দলটি। ফলে প্রায় ২৩ দিন পর ঘোষিত এই কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ঢাকা মহানগরে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি আছে ক্ষোভও। বরিশাল মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের অধিকাংশই বিক্ষুব্ধ। আর চট্টগ্রাম মহানগরেও একপেশে কমিটি গঠন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘোষিত কমিটিতে ঢাকা মহানগর উত্তরে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক হয়েছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, সদস্য সচিব করা হয়েছে দলের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সদস্য সচিব আমিনুল হককে। দুই সদস্যের দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবীনকে। বরিশাল মহানগরে তিন সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে মনিরুজ্জামান খান ফারুককে। তিনি সাবেক কমিটিরও আহ্বায়ক ছিলেন। সদস্য সচিব করা হয়েছে জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়াকে। তিনি সাবেক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়া সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে আফরোজা খানম নাসরিনকে। তিনিও আগের কমিটির সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগরে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে বিএনপি নেতা এরশাদ উলস্নাহকে এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে নাজিমুর রহমানকে। নবগঠিত চার আহ্বায়ক কমিটিকে আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কথা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। গত ১৪ জুন ঢাকা দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম ও সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক ডা. সাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর এবং বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ও সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবিরের নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। জানা গেছে, আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম ভ্যানগার্ড ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্তের পর থেকে পদপ্রত্যাশী নেতারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কিন্তু এবার সেই দৌড়ঝাঁপ খুব বেশি কাজে লাগেনি। বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, 'উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অধিকাংশ চেয়েছিলেন ঢাকা মহানগর কমিটিতে সিনিয়র-জুনিয়র সমন্বয় করে কমিটি দেওয়া হোক। ঘোষিত কমিটিতে সেটার প্রতিফলন না হওয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ। কারণ, এর আগে অবিভক্ত ঢাকা মহানগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মির্জা গোলাম হাফিজ, লে. জে. (অব.) মীর শওকত আলী, সাদেক হোসেন খোকা, মির্জা আব্বাস, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মতো হেভিওয়েট নেতারা দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই তুলনায় এবারের কমিটি অনেকটা তারুণ্য নির্ভর ও জুনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে করা হয়েছে। জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির প্রস্তাবিত কমিটির আলোচনায় আমিনুল হক আহ্বায়ক এবং যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর সদস্য সচিব ছিলেন। তবে যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব কারামুক্তির পর কমিটিতে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেন। আর ছিটকে পড়েন জাহাঙ্গীর। এছাড়া উত্তরের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কফিল উদ্দিনকে সদস্য সচিব করেও কমিটি প্রস্তত করা হয়েছিল। তবে শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তরে আমিনুল হক বিরোধীরা একাট্টা হয়ে নিরবের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তাকে দিয়েই কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি। সাইফুল আলম নিরব যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক থেকে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দীর্ঘ ১৫ বছরে কখনো রাজপথের আন্দোলনে মাঠে পাওয়া যায়নি। কমিটি গঠন নিয়েও তার নানান টালবাহানা ছিল। যুবদলের সভাপতি হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে একেবারে শেষ মুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন। এসব কারণে নিরবের এই পদ পাওয়ায় অনেকেই ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমিনুল হক দায়িত্ব পালনকালে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে কমিটি গঠনে তৎপর ছিলেন। তেমন কোনো অনিয়ম কিংবা কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেনি। এজন্য আবারো তার ওপর হাইকমান্ড আস্থা রেখেছেন। পদ পাওয়ার পর সাইফুল আলম নিরব বলেন, 'দল তার ওপর যে গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে সেই মর্যাদা রক্ষায় তিনিসহ মহানগরের প্রত্যেক নেতাকর্মী ও সমর্থক সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবেন।' এদিকে দক্ষিণ মহানগর কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই। কারণ রফিকুল আলম মজনু ও তানভীর আহমেদ রবিন সর্বশেষ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তানভীর আহমেদ রবিন বলেন, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা মহানগরে তার বাবার ওপর আস্থা রেখে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছেন। এবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ওপর যে গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছেন সেই মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবেন। এদিকে চট্টগ্রামের কমিটিও নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে মূল্যায়ন করার কথা বলা হলেও নবগঠিত কমিটির দুজনেই ছিলেন মাঠের বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলালের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে আগের মহানগর কমিটিকে নানান প্রতিবন্ধকতা দিয়ে বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা থেকেই এবার ভিন্ন কৌশলে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও শামীমের বাইরে গিয়ে এই কমিটি কতটুকু সফল হতে পারবে তা নিয়ে সন্দিহান নেতাকর্মীরা। চার মহানগরের মধ্যে বরিশালের কমিটিকে সবচেয়ে বিতর্কিত দাবি করছে অনেকে। অধিকাংশ নেতাকর্মীদের অভিযোগ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীনের অনুগতদের দিয়ে একদিকে যেমন একতরফা কমিটি গঠন করা হয়েছে, তেমনি কমিটিতে সিনিয়র-জুনিয়র সমন্বয়টাও জটিল করা হয়েছে। ফলে মহানগরের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতারা রাজনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক তেমন হেভিওয়েট কিংবা সাংগঠনিকভাবে খুব দক্ষ হিসেবে পরিচিত নয়। তবে ২৮ অক্টোবরের আন্দোলনের পর তিনি কারাগারে ছিলেন বলে তাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়া বিগত আন্দোলনে যেমন ভালো ভূমিকা রেখেছেন তেমনি সাংগঠনিকভাবেও অভিজ্ঞ। তবে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিনকে নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। তার মতো একজন কনিষ্ঠ নেতার নিচে মহানগর বিএনপির অন্যান্য প্রভাবশালী নেতাদের পদায়ন কীভাবে হবে- এটা ঘিরেই আপত্তি নেতাদের। যেসব নেতা বিগত দিনে কাউন্সিলর ছিলেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, বয়োজ্যেষ্ঠ এমন নেতাদের স্থান কোথায় হবে সেদিকে চিন্তা না করে একতরফা কমিটিতে অনেকের রাজনীতিই এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন নেতারা।