সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, চাঁনখারপুল মোড়, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার মোড়সহ গুটি কয়েক স্পটে 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি পালন করলেও এর প্রভাবে রোববার গোটা নগরীতে নজিরবিহীন যানজট ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েও যা ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ফলে নগরীর প্রায় প্রতিটি ব্যস্ততম সড়কেই গণপরিবহণ যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে ভয়াবহ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এ ছাড়া যানজট ও আন্দোলনকেন্দ্রিক অস্থিতিশীলতার কারণে শপিংমল, মার্কেট, বিপণিবিতানের বেচাকেনাসহ নগরীর সব ধরনে ব্যবসা-বাণিজ্যও একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গোটা ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
এদিকে ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করায় সেখানেও এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দেয়। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে গণপরিবহণের পাশাপাশি পণ্য পরিবহণেও সংকট সৃষ্টি হয়। থমকে যায় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, দুপুরের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাঁনখারপুল মোড় অবরোধ করায় হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, কমলাপুর, রামপুরা, হাতিরঝিল, নারায়ণগঞ্জ, পোস্তগোলা, পাগলা, ডেমরা স্টাফ-কোয়ার্টার, সিলেট, চিটাগাং রোড, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, কাঁচপুর যাওয়া-আসার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শত শত যানবাহন ফ্লাইওভারের ওপর আটকা পড়ে। এ সময় বিপুলসংখ্যক গণপরিবহণের যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগী ও তাদের স্বজনরাও এই ভোগান্তি থেকে রেহাই পাননি।
এ ছাড়া রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, বাংলামটর ও কারওয়ান বাজার মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে দীর্ঘ সময় অবস্থান নেন। দুপুরের আগ থেকে এই কর্মসূচি শুরু হলেও সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত তা কোথাও কোথাও
চলমান ছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, রাত ৮ পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। তবে রাতে তাদের আন্দোলনে দুষ্কৃতকারীরা ঢুকে পড়ে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে- এই আশঙ্কায় এক ঘণ্টা আগেই তা গুটিয়ে নেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, পূর্ব ঘোষিত 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি অনুযায়ী, বিকাল পৌনে ৪টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ফলে শাহবাগ ও তার আশপাশের এলাকার সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। সময় যত গড়াতে থাকে, সড়কে আটকে থাকা যানবাহনের সারি আরও দীর্ঘ হয়। এ সময় সেস্নাগানে সেস্নাগানে গোটা শাহবাগ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
পুলিশ জানায়, শুরুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে আসেন। এরপর একে একে শাহবাগ মোড়ের চারটি রাস্তা বন্ধ করে দেন। ফলে শাহবাগ থেকে প্রেস ক্লাবের দিকের রাস্তা, শাহবাগ থেকে বাংলামটরের দিকের রাস্তা, শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাবের রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় পল্টন মোড় থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে শাহবাগের দিকে আসা যানবাহগুলো ঘুরিয়ে কাকরাইল মসজিদের রাস্তাসহ অন্যান্য রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সুযোগ করে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। অন্যদিকে বাংলামটরের দিক থেকে আসা যানবাহনগুলো ইন্টারকন্টিনেন্টালের আগের রাস্তা দিয়ে বামে ঢুকে যায়। কিন্তু বিকালের পর আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে শাহবাগ থেকে পরিবাগ পর্যন্ত আন্দোলনের স্পট বিস্তৃত হয়। এতে বাইপাস করে যাওয়ার রাস্তাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।
পুলিশ জানায়, সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে শাহবাগ থেকে শিক্ষার্থীরা কারওয়ান বাজার এসে মোড়ের সবগুলো রাস্তা আটকে দেন। এতে কারওয়ান বাজার হয়ে বাংলামটর, পান্থপথ, ফার্মগেট ও এফডিসিমুখী রাস্তায় সব যানবাহন আটকা পড়ে। যদিও অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি কাজে নিয়োজিত যানবাহন চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়। দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকা থেকে যাত্রীরা অনেকে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কারওয়ান বাজার পার হতে দেখা গেছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পরে সন্ধ্যা ৬-৫০ মিনিটে শিক্ষার্থীরা কারওয়ান বাজার মোড় থেকে অবরোধ তুলে নিলে ধীরে ধীরে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এর ১০ মিনিট পর বাংলামটরের অবরোধও তুলে নেন আন্দোলনকারীরা। কারওয়ান বাজার ও বাংলামটরের শিক্ষার্থীরা শাহবাগের দিকে চলে যান।
এর আগে বিকাল ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হন এবং বিকাল ৩-২০ মিনিটে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এরপর তারা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।
এদিকে, আগারগাঁওয়ে বিকাল ৩-৪৫ মিনিটের দিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করেছেন বলে জানান শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদ আলী। এর ফলে ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
দুপুর দেড়টার দিকে সায়েন্স ল্যাব এলাকার সড়ক অবরোধ করে ঢাকা কলেজ ও আশপাশের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। অবরোধের কারণে তৈরি হওয়া যানজটে অচল হয়ে পড়েছে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত ও সায়েন্স ল্যাবসহ আশপাশের গোটা এলাকা। নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাব অভিমুখী সড়ক, শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাব অভিমুখী সড়ক, ধানমন্ডি এবং মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্স ল্যাবমুখী সব সড়কেই তৈরি হয় তীব্র যানজট। সবগুলো সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। হঠাৎ সড়ক অবরোধের কারণে বাস, সিএনজি ও প্রাইভেটকারসহ ব্যক্তিগত অন্যান্য যানবাহনে আটকা পড়েন কয়েক হাজার মানুষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ব্যস্ত মোড় অবরোধ করে আশপাশের এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। শুরুতে ট্রাফিক পুলিশ প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও পরে তারা হাল ছেড়ে দেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি চলবে। সারাদেশের ছাত্রসমাজ এই ইসু্যতে একত্রিত হয়েছে। কোটার নামে বৈষম্য চলতে দেওয়া হবে না। তাই অবিলম্বে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটা প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করতে হবে।
আবির হাসান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। কোটার নামে মুক্তিযুদ্ধকে অপমানিত করা হচ্ছে। যেখানে বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে নতুন করে কোটার মাধ্যমে সেই মুক্তিযুদ্ধকে নিচে নামানো হচ্ছে। বীর মুক্তিযুদ্ধাদের নাতি-পুতিরা কেন এমন সুবিধা পাবে। এটি যদি বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকে, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষার্থীদের অবরোধকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পর্যাপ্ত উপস্থিতি দেখা গেছে। চাঁনখারপুল মোড়ে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে উপস্থিত কোনো পুলিশ কর্মকর্তাই কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে দুপুরের পর এইচএসসি পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরতে গিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। এইচএসসি পরীক্ষা শেষে মেয়েকে নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি করে বাসায় ফিরছিলেন রিতা পারভীন নামে এক নারী। তিনি বলেন, 'ধানমন্ডি পর্যন্ত এই জ্যাম ছড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের খুব ভোগান্তি হচ্ছে। দুপুর ২টা থেকে রাস্তায় বসে আছি, এখন সাড়ে ৩টা বাজে।'
গাজীপুরগামী ভিআইপি বাসের চালক হামিদ বলেন, 'মামা কী হইছে কিছু বলতে পারি না। গাড়ি নিয়া দুই ঘণ্টা দাঁড়ায়া আছি। পেছনে গাড়ির সারি। ঘুরিয়ে যে চলে যাব, সেই সুযোগও নাই।' যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে অনেককেই বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হন বলে জানান এই বাসচালক।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাহমুদুল হাসান দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রাইভেটকারে খিলগাঁও থেকে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিলেন। এই দূরত্ব যেতে তার সাধারণত ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু তিনি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের কাছে পৌঁছে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট রুটে ব্যাপক যানজটে পড়েন তিনি। পরে রুট বদলে অন্য পথে আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় পর তিনি গন্তব্যে পৌঁছান।
তিনি বলেন, হঠাৎ যানজটে পড়ে পথ পাল্টাতে হয়েছে। কিন্তু সব রাস্তাতেই তীব্র যানজট। ফলে রাস্তা পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হয়নি। এমন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তিনি আর গাড়ি বের করবেন না।
এদিকে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, রায় সাহেব বাজার মোড়, বংশাল, গুলিস্তান, পুরানা পল্টন, আগারগাঁও, মিরপুরের কাজী পাড়া, শেওড়া পাড়া ও মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকাতেও তীব্র যানজটের খবর পাওয়া গেছে। এসব সড়কে গণপরিবহণের যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
যানজটে দীর্ঘ সময় গাড়িতে বসে থেকে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রেদোয়ান আহমেদ নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, 'কোনো সুস্থ মানুষ একটানা ৪ ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকে কীভাবে?' মোনালিসা মোনা নামের একজন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফেসবুকে লিখেছেন, 'শেওড়াপাড়ায় দুপুর সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত যানজটে আটকে আছি। এইটা কোনো কথা? এখনো জানি না, কখন রাস্তা ছাড়বে। এ রকম আর কত দিন চলবে?'
এদিকে যাত্রাবাড়ী মোড়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা বাসগুলো সড়কের একই স্থানে থেমে আছে। যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে বাস থেকে নেমে হেঁটে রওনা করেছেন। আর বাসগুলো বন্ধ করে চালক ও সহকারীরা ভেতরে অবস্থান করছেন।
ঢাকা-হবিগঞ্জ রুটের অনিক পরিবহণ নামের একটি বাসচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেড় কিলোমিটার রাস্তা পাড় হতে তার ৪৫ মিনিট সময় লেগেছে। এখন যাত্রাবাড়ী সিগন্যালে বসে আছেন ২৫ মিনিট ধরে।
যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে এক কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ কুতুবখালী এলাকার ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাত্রাবাড়ীর দিকে আসছিলেন ভৈরব থেকে আসা তসলিম উদ্দিন। তার মাথায় ২০ কেজির চালের বস্তা। আর পিঠে আরেকটি ব্যাগ। সঙ্গে হাঁটছেন স্ত্রীও। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক ঘণ্টা গাড়িতে বসে বিরক্ত হয়ে নেমে গেছেন। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, এটা শুনে হেঁটেই যাত্রা করেছেন। যাবেন রামপুরায়।