আইনি কাঠামোর মধ্যে আসেনি ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠছে যানবাহনগুলো। রীতিমতো ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব যানবাহন। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলারকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে পৃথক একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এসব যানবাহন পুরোপুরি একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আসছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকার মূল সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে কোনো ধরনের বাধা বিপত্তি ছাড়াই। এমনকি দিন যত যাচ্ছে রাজধানীর মূল সড়কে এ ধরনের যানবাহনের চাপ তত বাড়ছে। এসব যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে পুলিশের তরফ থেকে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে না। যদিও ঢাকার মূল সড়কগুলোতে এসব যানবাহন চলাচলের আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমতি দেয়ার পর পুলিশ আর কিছুই বলে না। সেই সুযোগে যানবাহনগুলো দেদার ঢাকার মূল সড়কে চলাচল করছে। পুলিশও বাধা দেয়ার সাহস করে না। এমনকি দেয় না। এতে করে এসব যানবাহনের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দামও। আগে এসব যানবাহন ৫০ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম প্রায় এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা। একটি নতুন রিকশা, চারটি নতুন ১২ ভোল্টের ব্যাটারি, ১টি ছোট জেনারেটর ও আনুষঙ্গিক ছোটখাটো যন্ত্রপাতি মিলিয়ে অনেক টাকা খরচ পড়ে যায়। চাহিদা বেশি হওয়ায়
এসব যন্ত্রপাতির আমদানিও বাড়ছে। তবে রিকশার চেয়ে তিন চাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাম অনেক বেশি। প্রতিটি অটোরিকশা বর্তমানে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রাফিকের সকল সদস্যকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন যাতে ঢাকার মূল সড়কে চলাচল করতে না পারে, এজন্য স্পষ্ট ও কড়া নির্দেশনা রয়েছে। এসব যানবাহন শুধুমাত্র পাড়া মহলস্নার গলির রাস্তায় চলাচল করতে পারবে। কোনোভাবে মূল সড়কে চলাচল করতে পারবে না। ট্রাফিক পুলিশের তরফ থেকে প্রায়ই মূল সড়কে চলাচল করা যানবাহন জব্দ করা হচ্ছে। এমনকি এমন অভিযান ধারাবাহিকভাবে পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে।
রিকশাচালক মফিজ বলছিলেন, এসব ব্যাটারিচালিত যানবাহন নিয়ে যথেষ্ট আতঙ্কে থাকতে হয়। এমন মতামত দিয়েছেন অধিকাংশ চালক। তাদের দাবি, যানবাহনগুলোর কোনো বৈধতা নেই। এসব যানবাহনের কোনো নম্বর পেস্নট না থাকায় চোর ও ছিনতাইকারীরা সেই সুযোগ নিচ্ছে। যে কারণে হরহামেশাই এসব যানবাহন চুরি ও ছিনতাই হচ্ছে। অনেক সময় চালকদের হত্যার শিকারও হতে হচ্ছে। অনেক চালক আবার অজ্ঞান পার্টি-মলমপার্টির খপ্পরে পড়ছেন।
এসব বিষয়ে পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার যায়যায়দিনকে বলেন, চুরি বা ছিনতাইয়ে বাধা দিলে প্রায়ই চালককে হত্যাকান্ডের শিকার হয়। হত্যার শিকার হওয়া চালকদের দূরের কোনো নির্জন জায়গায় ফেলে দিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। পরবর্তীতে অজ্ঞাত লাশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হচ্ছে। বিশেষ করে জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এসব যানবাহনকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হলে চালকদের খুন হওয়ার হার আশঙ্কাজনকহারে কমে যাবে। কারণ চালক ও যানবাহনের পরিচিতি সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তথ্য থাকবে। এতে করে চালকের পরিচয় শনাক্ত হওয়া এবং খুনিকে শনাক্ত করা অনেকটাই সহজ হবে। যা দ্রম্নত মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়ক হবে।
ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ'র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার যায়যায়দিনকে বলেন, উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ সংক্রান্ত পৃথক একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উলস্নাহ নূরী যায়যায়দিনকে বলেন, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্বল্পসময়ের মধ্যেই বিষয়টি প্রকাশ করা হবে। নীতিমালায় কি কি বিষয় থাকছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন সংক্রান্ত সকল বিষয় এই নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে চলাচল সম্পর্কিত স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এসব যানবাহন কোন কোন ধরনের রাস্তা বা সড়কে বা মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে তা স্পষ্টভাবে উলেস্নখ থাকবে। এসব যানবাহন তৈরি করতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকছে। এছাড়া নম্বর পেস্নট, ইঞ্জিন, যানবাহনের গঠন বা কাঠামো, ইঞ্জিনের ক্ষমতা বা সিসি বা হর্স পাওয়ার, চালকদের লাইসেন্সের ধরন যেমন পেশাদার নাকি অপেশাদার, রং, দেশের কোন কোন জায়গায় চলাচল করতে পারবে, সমগ্র দেশে চলাচল করতে পারবে কিনা, মোট কথা ব্যাটারিচালিত রিকশা সংক্রান্ত যত বিষয়াদি আছে তার সবই অন্তর্ভুক্ত থাকছে নীতিমালায়। আশা করছি স্বল্পসময়ের মধ্যেই নীতিমালা তৈরি ও অনুমোদনসহ সার্বিক কার্যক্রম শেষ হবে। ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন পুরোপুরি আইনি কাঠামোর মধ্যে আসছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ১৫ মে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুর্ঘটনারোধে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেন। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। জব্দ করে শত শত যানবাহন। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক ও মালিকদের কঠোর আন্দোলনে মিরপুর এলাকার সড়ক অবরোধ, যানবাহন, ট্রাফিক পুলিশের বক্স ভাংচুর ও মেট্রোরেলের স্টেশন ভাংচুরসহ পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করার অনুমতি দেন। ফলে বন্ধ হয় এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে চলা সব অভিযান।
পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে দেশের ২২টি মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ থাকবে। এর আগে ২০২২ সালে উচ্চ আদালত দুর্ঘটনা এড়াতে মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়।
হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অপারেশনস) শ্যামল কুমার মুখার্জী যায়যায়দিনকে বলেন, মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত ছোট ছোট যানবাহন যাতে চলাচল করতে না পারে, এজন্য আদালতের যেমন স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, তেমনি হাইওয়ে পুলিশের তরফ থেকেও আছে কড়া নজরদারি ও টহল ব্যবস্থা। কারণ এসব যানবাহনের কারণে প্রায় মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণহানি ঘটে অনেকের। অনেকেই আবার চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। দুর্ঘটনার সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। তাই মহাসড়কে ছোট ছোট যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নজর রাখা হয়। তারপরেও সার্ভিস লেন দিয়ে অনেক সময়ই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছোট ছোট যানবাহনের চলাচল করার খবর শোনা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে কমপক্ষে অর্ধকোটি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলছে। যার মধ্যে অন্তত ৮ থেকে ১০ লাখ চলছে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায়। এসব যানবাহনের কোনো আইনগত বৈধতা নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। এমনকি এসব যানবাহন ঘিরে তৈরি হয়েছে এক শ্রেণির চাঁদাবাজ শ্রেণি। যার মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছাড়াও পরিবহণ খাতের নানা ব্যক্তি এবং সংগঠন জড়িত।