সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শনিবার যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ আটটি নদীর পানি বিভিন্ন স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উজানের পাহাড়ি ঢল আর উজানে কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ আগের তুলনায় বেড়েছে। টানা ছয় ঘণ্টা ধরে বিপৎসীমার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পস্নাবিত হওয়ায় লালমনিরহাটের নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলসহ নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
এদিকে দফায় দফায় বন্যায় খাদ্য, সুপেয় পানিসহ নানা সংকটে ভুগছেন বানভাসি মানুষ। যমুনার পানি জামালপুর পয়েন্টে ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলার ৮৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পস্নাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলা, পাট ও মৌসুমী ফসলের ক্ষেত। কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। বন্যার মধ্যেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব অঞ্চলের লোকজন।
অন্যদিকে, শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং দেশের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে চলমান বন্যায় দেশের ১৫ জেলা আক্রান্ত এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী জানান, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, জামালপুর, গাইবান্ধা, ফেনী, রাঙামাটি, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট ও কক্সবাজার জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ২২৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যা আক্রান্ত ১৫ জেলায় এ পর্যন্ত তিন কোটি ১০ লাখ টাকা, আট হাজার ৭০০ টন ত্রাণের চাল, ৫৮ হাজার ৫০০ বস্তা শুকনো ব্যাগও অন্যান্য খাবার, শিশু খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা এবং গো-খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বন্যা বিস্তৃতি লাভ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বন্যা আক্রান্ত অঞ্চল নিয়ে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃতি লাভ করলে সেই জায়গাগুলোকেও আমরা এড্রেস করব। বন্যার কারণে দক্ষিণ দিকেও পস্নাবিত হতে পারে।
নির্ঘুম রাত তিস্তাপারের বাসিন্দাদের : লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে শনিবার দুপুরে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ০৫ মিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা সকাল ৯টা থেকে অব্যাহত রয়েছে।
বন্যা সতর্কীকরণ
কেন্দ্র ও চরবাসী জানান, ভারতের সিকিমে উৎপত্তিস্থল থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। নদীর বাংলাদেশ অংশের উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা পানি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ফারাক্কা গেট খুলে বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেওয়া হয়। একইভাবে শুষ্ক মৌসুমে গেট বন্ধ করে বাংলাদেশকে মরুভূমি করে তিস্তার পানি একক ব্যবহার করছে ভারত সরকার।
বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় উজানে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে ভারত তাদের অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এই উজানের ঢলে তিস্তার পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাত। ফলে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দিকে এগিয়ে আসছে।
তাই বর্ষাকাল শুরু হলেই বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢেউয়ের কারণে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হতে শুরু করেছে। ডুবে গেছে চরাঞ্চলের সড়ক পথ। চরবাসীর যাতায়াতের মাধ্যম হয়েছে নৌকা।
টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢেউয়ের কারণে বন্যার শঙ্কা করছেন তিস্তা পাড়ের মানুষ। বন্যার সময় পানিবন্দি জীবন কাটিয়ের উঠার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন চরবাসী ও নদী তীরবর্তী পরিবারগুলো। নদী পাড়ের মৎস্যচাষিরা তাদের পুকুরের মাছ রক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বন্যা হলে ভেসে যেতে পারে লাখ লাখ টাকার মাছ। গবাদিপশু পাখি নিয়েও বিপাকে নদী পাড়ের মানুষ। তাই বন্যার শঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটছে নদীর পাড়ের মানুষের।
তিস্তা ব্যারাজ বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ শনিবার সকাল ৬টায় ছিল ১৮ সেন্টিমিটারের নিচে, ৯টায় ছিল ১০ সেন্টিমিটারের নিচে এবং দুপুর ১২টায়ও অপরিবর্তিত রয়েছে। টানা ৬ ঘণ্টা ধরে ১০ সেন্টিমিটারের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২০ মিলিমিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা বলেন, 'সকাল ৯টা থেকে তিস্তা নদীর এই পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হতে পারে।'
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উলস্ন্যাহ বলেন, 'নদ-নদীর পানি খবর সার্বক্ষণিক নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে নদী তীরবর্তী এলাকার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।'
এদিকে, শনিবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, সকাল ৯টায় দেশের ১০টি নদীর পানি ২১টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। ওই সময় বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের ১১০টি স্টেশনের মধ্যে ৪২টি পয়েন্টে পানি কমার প্রবণতা দেখা গেলেও ৬৩ পয়েন্টে বাড়ছিল আর অপরিবর্তিত ছিল পাঁচটি পয়েন্টে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদীর পানি সময় বিশেষে দ্রম্নত বাড়তে পারে। এতে তিস্তা নদীর পানি কিছু পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদী সংলগ্ন কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হতে পারে।
এ সময় দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনাশ্বরী, করতোয়া, বাঙালী, আপার করতোয়া, পুর্নভবা, টাঙ্গন, ইছামতি-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট যমুনা নদীর পানিও বাড়তে পারে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সার্বিকভাবে কমছে, এ অবস্থা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, 'পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে পারে। ৭ তারিখের দিকে উন্নতির দিকে যাবে, তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে ১১ তারিখ পর্যন্ত লেগে যাবে।'
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা ও খুলনা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।
কুড়িগ্রামে ২০ স্থানে ভাঙন
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের পর এবার ধরলা ও দুধকুমার নদের পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পস্নাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। ভাঙন দেখা দিয়েছে ২০টি স্থানে। লোকালয় পস্নাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তিন লক্ষাধিক মানুষ।
শনিবার সকালে স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের তথ্য মতে, জেলার তিস্তা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, কালজানী, সংকোশসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বাড়ায় নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। বন্যায় জেলার ৯টি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের তিন শতাধিক গ্রামের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গত শুক্রবার পাঁচটি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি ছিলেন।
শনিবার সকাল ৯টায় কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, জেলার প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রাম সদর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৭২ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৬৮ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে ৭১ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কয়েক দিন থেকে ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবল স্রোতে চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের কাচকোল এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ডানতীর রক্ষা বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ইউনিয়নের দুই শতাধিক পরিবার। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ফেলে ধস ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
কুড়িগ্রামের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, 'রানীগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র বাঁধের কয়েকটি স্থানে তীব্র স্রোতে ধস দেখা দিয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন সেখানে বালুর বস্তা দিয়ে ধস মেরামত করে ভাঙন ঠেকানোর কাজ করেছেন। আপাতত কোনো ভয় নেই। এ ছাড়া জেলার ২০টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে।'
প্রতিদিন ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পাড়ে নতুন নতুন চর ও বসতবাড়ি ডুবে যাচ্ছে। বানভাসি মানুষের ঘরবাড়িতে কোথাও বুক পানি আবার কোথাও গলাসমান পানি। এসব এলাকার বানভাসি মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছেন।
জেলা শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পস্নাবিত হয়েছে। আর ১৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান ও পরীক্ষা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০৩টি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৭টি আছে। এ ছাড়া রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার ছয়টি কলেজ পস্নাবিত হয়েছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, 'বন্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত আছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে যেখানেই বন্যার্ত মানুষের সংকটের কথা জানতে পারছেন, সেখানেই ত্রাণ পৌঁছানো হচ্ছে।'
সিরাজগঞ্জে ২ জনের মৃতু্য
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার শাহজাদপুরে বন্যার পানিতে ঘুরতে বেরিয়ে নৌকাডুবে দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও একজন। শনিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে উপজেলার রেশমবাড়ির পথে পোতাজিয়া চারমাথা এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। মৃতরা হলেন- উপজেলা পৌর শহরের দারিয়াপুর মহলস্নার শাহ আলমের ছেলে সজল (১৬) ও একই মহলস্নার তৌহিদের ছেলে তন্ময় (১৮)।
শাহজাদপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন লিডার খোরশেদ আলমের বরাত দিয়ে সেখানকার থানার ডিউটি অফিসার মকবুল হোসেন বলেন, 'তারা ৯জন একটি নৌকা নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এ সময় নৌকাটি রেশমবাড়ির পথে পোতাজিয়া চারমাথা এলাকায় পৌঁছতেই ডুবে যায়। পরে স্থানীয়রা খবর দিলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে। যেখানে নৌকাটি ডুবেছিল, সেখানে অনেক পানি ছিল। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয়রা দুইজনের লাশ উদ্ধার করে। ৯ জনের মধ্যে সাতজন সাঁতার জানায় তারা পাড়ে গিয়ে উঠলেও বাকি দুইজন ডুবে মারা যান'
শেরপুরের ৪০ গ্রাম পস্নাবিত
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে শেরপুর সদর ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ৪০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। তবে জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার খবর জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত শেরপুর সদরে ছয় মিলিমিটার, নালিতাবাড়ীতে আট মিলিমিটার এবং নাকুগাঁওয়ে ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানায় পাউবো। পাহাড়ি ঢলে সদর উপজেলার গাজীরখামার ও নালিতাবাড়ীর কলসপাড় ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় অনেক পুকুরের মাছ ভেসে। এ ছাড়া আমনের বীজতলা ও সবজি খেত তলিয়ে গেছে। বাড়িঘরে পানি উঠায় দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় হাঁটু পানি মারিয়ে এবং ছোট নৌকায় চলাচল করছেন বাসিন্দারা। প্রতিদিন থেমে থেমে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার পশ্চিম কলসপাড় গ্রামের কৃষক শাহজাহান বলেন, 'কলসপাড় ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ড পূর্ব কলসপাড় থাইকা ধইরা কাশেমপুর অইয়া গাগলাজানি, নাকশি, বালুঘাটা, তারাকান্দি, যোগানিয়া এসব এলাকায় জালাজুলা আমরা ফালাইছি সব খাইয়া গেছে গা।'
শনিবার সকাল ৯টায় শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান জানান, নাকুগাঁও পয়েন্টে ভোগাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৪৪ সেন্টিমিটার এবং নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ১৯৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া চেলস্নাখালী নদীর পানি বাতকুচি পয়েন্টে ৯৬ সেন্টিমিটার এবং পুরনো ব্রহ্মপুত্রের পানি ২০৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা জানান, আকস্মিকভাবে আসা পানি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এরপরও বন্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পরে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে।
জামালপুরে ৮৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পস্নাবিত
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, শনিবার সকালে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বন্যার পানিতে জেলার ৮৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পস্নাবিত হয়েছে। লোকালয় পস্নাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় লোকজন। পস্নাবিত হয়েছে দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন। তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। শনিবার সকালে এমন পরিস্থিতির কথা জানা যায়।
জেলা শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানিতে জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৮৬টি বিদ্যালয় পস্নাবিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৩টি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩৩টি। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ১৯টি, ইসলামপুরের ১৬, মাদারগঞ্জের ১৫, মেলান্দহের দুই ও সরিষাবাড়ি উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পস্নাবিত হয়েছে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম মোজাম্মেল হক বলেন, 'জেলায় ৩৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পানি ঢুকেছে। শুক্রবার ও শনিবার দুই দিন সরকারি বন্ধ। তাই বন্ধ ঘোষণার প্রয়োজন হয়নি। এ অবস্থা থাকলে বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হবে।'
রেলস্টেশনে আবুল হোসেন নামে এক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, 'জরুরি কাজে জামালপুর শহরে যাবেন। এখন একটি লোকাল ট্রেন জামালপুরে যাবে। এই ট্রেন ধরার জন্য হাঁটু পানি মারিয়ে স্টেশনে এসেছেন। বন্যার কারণে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।'
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার থেকে যমুনার পানি বেড়ে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার সদর ইউনিয়ন, চিনাডুলী, পাথর্শী, সাপধরী, বেলগাছা, কুলকান্দি, নোয়ারপাড়া, পলবান্দা; দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়ন, চিকাজানী, চুকাইবাড়ী, বাহাদুরাবাদ, চরআমখাওয়া, ডাংধরা, পাররামরামপুর, হাতিভাঙ্গা, পৌরসভার আংশিক; মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া, আদ্রা, মাহমুদপুর, নাংলা, কুলিয়া; মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকেরদহ ও জোড়খালী ইউনিয়নের এলাকা পস্নাবিত হয়। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি।
সোনাতলায় ২০ গ্রাম পস্নাবিত
সোনাতলা (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানিতে উপজেলার ২০ গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী শনিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সমতল পানি প্রবাহের মাত্রা ১৬.৮৩ মিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ ছাড়াও বন্যায় উপজেলার ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পস্নাবিত হয়েছে। এসব বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। পস্নাবিত এলাকার কিছু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে আর কিছু মানুষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শারমিন কবিরাজ বলেন, 'চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য অস্থায়ী ও স্থায়ীভাবে দুই ধরনের ক্যাম্প পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউনিয়নভিত্তিক এবং আমাদের তত্ত্বাবধানে স্থায়ীভাবে লোকজনদের সেবা দেওয়া হবে।'
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বলেন, 'ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বন্যা পরিস্থিতি আগের মতোই রয়েছে। ত্রাণ সহযোগিতা অব্যাহত আছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত উপকরণ আছে এবং প্রয়োজনমাফিক চাহিদা পাঠালে জেলা থেকে সহায়তা করা হবে।'
নাগেশ্বরীতে ভেঙেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া এলাকার দুধকুমার নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ১০০ মিটারের বেশি জায়গাজুড়ে ভেঙে গেছে। এতে করে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে প্রায় ১০ গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব গ্রামের পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ। বন্যার পানি গ্রাম ছেড়ে প্রবেশ করছে নাগেশ্বরী পৌরসভার বেশ কয়েকটি এলাকাতেও। বাঁধ ভাঙায় পানির স্রোতে ভেঙে যাচ্ছে বিভিন্ন রাস্তাঘাট। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নসহ পাশের অনেক এলাকা। শুধু বামনডাঙ্গা ইউনিয়নই নয়; বন্যার পানিতে রায়গঞ্জ, কালিগঞ্জ, বলস্নভেরখাস, ভিতরবন্দ, নুনখাওয়া, কচাকাটা, নারায়ণপুর ইউনিয়ন ও নাগেশ্বরী পৌরসভাসহ প্রায় ২০ হাজার পরিবারের ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের এলাকার জয়নাল আবেদিন জানান, সকাল থেকে পানি হু হু করে বাড়ছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে বাঁধের বাকি অংশগুলো ভেঙে গিয়ে সবার বাড়ি তলিয়ে যাবে। তাই অতি দ্রম্নত বাঁধ ভাঙন ঠেকাতে না পারলে দুর্ভোগে পড়বেন এখানকার হাজার হাজার মানুষ।
বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রনি জানান, ভারী বৃষ্টি আর উজানের পানির কারণে শনিবার সকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ইতোমধ্যে ৮-১০ গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। আর যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে করে বাকি অংশ ভেঙে গেলে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নসহ অন্যান ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা পস্নাবিত হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, 'এটা পুরনো রাস্তা। অন্যদিকে আমাদের কাজ চলমান থাকলেও এখনো সেদিকে (মিয়াপাড়া এলাকায়) রাস্তার কাজ শুরু হয়নি। এরপরও রাস্তার ভাঙন ঠেকাতে অতি দ্রম্নত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'