কোটাবিরোধী আন্দোলনে ভারী হচ্ছে ভোগান্তির পালস্না
প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সড়ক-রেলপথ অবরোধ, ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচিতে দেশজুড়ে ভারী হচ্ছে ভোগান্তির পালস্না। বিশেষ করে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন মহাসড়ক দীর্ঘসময় অবরোধ করে রাখায় তীব্র যানজটে পণ্য পরিবহণ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে পরিবহণ খরচ আরও এক ধাপ বেড়ে মূল্যস্ফীতি উসকে ওঠার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। যা উচ্চমূল্যের কষাঘাতে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে তাতে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি শিগগিরই আরও বাড়বে। বিগত সময়ের মতো এ নিয়ে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটবে। এতে জনভোগান্তি ভয়ংকর রূপ নেবে। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হার্ডলাইনে নামলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি এ আন্দোলন নাশকতায় মোড় নিয়ে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে কোটাবিরোধী
আন্দোলন শুরুর এক সপ্তাহের মাথায় গতকাল শনিবার বিএনপি এতে সমর্থন জানানোর পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের তৎপরতা নতুন করে আরও এক ধাপ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে আন্দোলনের নামে যাতে কোনো ধরনের জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরসহ নাশকতার ঘটনা ঘটতে না পারে সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, সরকারের সতর্কতার পরও কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে সহসাই জনভোগান্তির পালস্না আরও ভারী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগেও ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। তাতেও একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। সে সময়ও জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছিল। যা সামাল দেওয়ার আগেই সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এ নিয়ে নির্ভার থাকার সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপি সমর্থন জানিয়ে তাতে সরাসরি সম্পৃক্ত না হওয়ার কথা জানালেও মাঠে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাদের দেখাদেখি সরকারবিরোধী অন্য রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবে। তারা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এ আন্দোলনে রসদ জোগাবে। যা আন্দোলনকে বেগবান করবে। আর এতে নিঃসন্দেহে ভোগান্তি আরও বাড়বে।
এদিকে আন্দোলনকারীদের সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর কতটা পড়েছে তা পর্যালোচনায় উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা জানান, সরকারি দুই দিনের ছুটিতে সাধারণ সময় যাত্রী সংখ্যা বেশি থাকে। অনেকে বৃহস্পতিবার বিকালে অফিস ছুটির পর গ্রামে চলে যান। শুক্রবার-শনিবার সেখানে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে রোববার ভোরে কর্মস্থলে ফিরে আসেন। তবে এবার সে চিত্র ছিল বেশখানিকটা ভিন্ন। কেননা শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচিতে কখন কোন মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এ আশঙ্কায় অনেকেই এবার বাড়িমুখো হননি।
ঢাকার সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা শুকুর আলী জানান, ব্যবসায়িক কাজ শেষে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি যশোর থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখায় ঢাকা-আরিচা সড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। যা স্বাভাবিক হতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। এতে পথে পথে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তাই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগান্তি এড়াতে এ সপ্তাহে তিনি কোনো কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিডিউল রাখেননি।
একই আশঙ্কা প্রকাশ করে বগুড়ার চাল ব্যবসায়ী মোকাম্মেল হোসেন বলেন, যেভাবে শিক্ষার্থীরা হুটহাট করে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করছে তাতে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় মাল পাঠাতে ব্যবসায়ীরা অনেকে ভয় পাচ্ছেন। কেননা অবরোধের ফাঁদে পড়ে একদিকে যেমন নির্ধারিত সময়ে মাল গন্তব্যে পৌঁছে না, তেমনি ক্ষয়ক্ষতিরও আশঙ্কা থাকে।
ওই ব্যবসায়ীরা দাবি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে পণ্যপরিবহণ খরচও বেড়ে যায়। কেননা দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা পথে গাড়ি নামাতে চান না। এছাড়া তাদের জ্বালানিও বেশি খরচ হয়- এই অজুহাতে তারা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩/৪ হাজার টাকা বেশি ভাড়া আদায় করেন। যার প্রভাবে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম জানান, তার পণ্যবাহী একটি ট্রাক গতকাল ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে শিক্ষার্থীদের অবরোধে সৃষ্ট যানজটের কবলে পড়ে। এতে নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন ঘণ্টা পর মাল বাজারে পৌঁছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকার কারণে তাকে শুধু ট্রাক ভাড়াই বেশি দিতে হয়নি, নির্ধারিত ক্রেতাও হারাতে হয়েছে। এ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ওই ব্যবসায়ী।
তবে রাজনীতিকরা অনেকেই মনে করেন এ নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়েও অরাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে বেশি সতর্ক সরকার। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে ভর করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যাতে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে না পারে এজন্য সরকার ও দল উভয়ই সতর্ক রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে দেশ পরিচালনায় অনাহূত আন্দোলন বা অস্থিরতা এড়িয়ে চলতে চায় সরকার। যদিও এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই।
আওয়ামী লীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে সরকার এখন নির্ভার। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীরা যেভাবে গত কয়েকদিন ধরে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করছে তা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ অবস্থান এবং যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কেননা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকাকে সরকার সব সময়ই আন্দোলনমুক্ত রাখতে চায়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের গত (২০১৪-২০১৮) মেয়াদে অরাজনৈতিক সংগঠনের বেশ কয়েকটি আন্দোলন সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন সরকারকে বড় ধরনের 'ভোগান্তিতে' ফেলেছিল। তাই এবার প্রথম থেকেই অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিয়ে সতর্ক থাকবে সরকার। বিশেষ করে কোনো ধরনের আন্দোলনের নামে দেশে অসহিষ্ণু পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক আর এতে জনভোগান্তি ভয়াবহ রূপ নিক তা কোনোভাবেই হতে দেবে না।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় প্রস্তুত বিশৃঙ্খল-প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কোনো দুষ্টচক্র যাতে জনভোগান্তি তৈরি করতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য। এছাড়া বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই যাতে এ ব্যাপারে আগাম তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সেজন্য রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, সরকারের কাছে তথ্য আছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো আপাতত কঠোর আন্দোলনে মাঠে নামছে না। তবে অরাজনৈতিক কোনো সংগঠনের আন্দোলন সংগঠিত হলে সেখানে 'ভর করে ফায়দা নেওয়ার' চেষ্টা করবে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যায়। এ কারণে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের চেয়ে অরাজনৈতিক সংগঠনের আন্দোলনের ব্যাপারে সরকার আগে থেকেই সতর্ক।
এদিকে গত কয়েকদিন ধরে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা রাজধানী ঢাকার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখায় এ পথ ব্যবহারকারী গণপরিবহণ যাত্রী, পথচারী এবং আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
শনিবার বিকাল ৫টার দিকে শাহবাগ মোড়ের চারপাশের রাস্তাগুলোতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাস, প্রাইভেটকারসহ নান ধরনের কয়েকশ' যানবাহন আটকে থাকতে দেখা যায়। বারডেম হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো ৮ নম্বর বাসের যাত্রী নিজামুল জানান, প্রায় ৪০ মিনিট তিনি যানজটে আটকা পড়ে আছেন। কিন্তু বাস সামনে এগোচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তাকে বাস থেকে নেমে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে হবে। আন্দোলনে যা-ই হোক না কেন দিনশেষে সাধারণ জনগণকেই এর ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।
হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে অটোরিকশা চালক সাইফুল জানান, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালের সামনে থেকে একজন যাত্রী তুলে পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মোড়ে এসেই যানজটে আটকা পড়েছেন। না পারছেন সামনে এগোতে, না পারছেন অটোরিকশা ঘুরিয়ে অন্য কোনো পথ্যে গন্তব্যে যেতে।
ওই অটোরিকশার যাত্রী ইলেকট্রিক পার্টস ব্যবসায়ী কামাল মজুমদার বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন সবে জমতে শুরু করেছে। এখনই চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আন্দোলন জমে উঠলে গোটা ঢাকা শহর স্থবির হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।