আজ থেকে সারাদেশে 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি ঘোষণা
কোটা আন্দোলনে উত্তাল শিক্ষাঙ্গন
শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অচল পুরান ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
কোটা সংস্কার ও ২০১৮ সালের মেধাভিত্তিক নিয়োগে সরকারি পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে শিক্ষাঙ্গন। আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কোটা ইসু্যতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শনিবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে শামিল হন। এদিন ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-রাজশাহী, খুলনা-ঢাকা, ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এতে মহাসড়কগুলোর উভয় পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়তে হয় জনগণকে। এদিকে, রাজধানীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে পুরান ঢাকা অচল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শনিবার বিকালে রাজধানীর শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচি শেষে আজ রোববার থেকে সারাদেশে 'বাংলা বস্নকেড' নামে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে কোটা সংস্কার ইসু্যতে চার দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলো হলো- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা। পরিপত্র বহালসাপেক্ষে কমিশন গঠনপূর্বক দ্রম্নত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া (সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী ব্যতীত)। সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে কয়েকদিন রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে শনিবার অবরোধ তুলে নেন তারা। এক ঘণ্টার মতো অবরোধ শেষে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা সরে দাঁড়ালে শাহবাগ মোড় দিয়ে ফের যান চলাচল শুরু হয়। তবে অবরোধ প্রত্যাহারের আগে আজ রোববার বিকাল
৩টা থেকে 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এদিন বিকাল ৪-৪০ মিনিটের দিকে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করেছিলেন। অবরোধের কারণে শাহবাগ মোড়ের সড়ক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে চারপাশের সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হয়।
অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'কাল বিকাল ৩টা থেকে 'বাংলা বস্নকেড' কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। শুধু শাহবাগ মোড় নয়, শাহবাগ ও ঢাকা শহরের সায়েন্স ল্যাব, চানখাঁরপুল, নীলক্ষেত, মতিঝিলসহ প্রতিটি পয়েন্টে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা নেমে এসে কর্মসূচি সফল করবেন। ঢাকার বাইরের জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করবেন।'
ছাত্র ধর্মঘট ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিতে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে উলেস্নখ করে নাহিদ আরও বলেন, 'শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে গেলেও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরে যাব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার অবিলম্বে খুলে দিতে হবে, নয়ত আমরা নিজ দায়িত্বে সেটি খুলে নিতে বাধ্য হব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দিচ্ছে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা। আমরা কিন্তু হলের তালা ভাঙতে জানি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানাই।'
এর আগে বিকাল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে থেকে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ব্যানারে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের শ্যাডো ও মলচত্বর প্রদক্ষিণ করে মাস্টারদা সূর্যসেন হল ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সামনে দিয়ে স্মৃতি চিরন্তন চত্বর, টিএসসি ও বকশীবাজার হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে পলাশী ও আজিমপুর এলাকা ঘুরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে থামে।
মিছিলটি শাহবাগে আসার আগে থেকেই জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য অবস্থান করছিলেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের একটি অংশও জাদুঘরের সামনের সড়কে মিছিল আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। মিছিলটি চারুকলা অনুষদের সামনে আসতেই অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪-৩৭ মিনিটে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। এর ঠিক আগেই পুলিশ সদস্যরা শাহবাগের সড়কে অবস্থান নেন, তবে তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দেননি। মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে মূল মিছিলটি শাহবাগ মোড়ে অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর তারা বিভিন্ন স্স্নোগান দিয়ে ৫০ মিনিট এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
এর আগে দুপুরে একই দাবিতে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে সড়ক অবরোধ করে টানা দুই ঘণ্টা ধরে আন্দোলন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের অবস্থানের কারণে পুরান ঢাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে বাবুবাজার ব্রিজ পার হয়ে কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, দয়াগঞ্জ এলাকায় গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হয়।
এ সময় শিক্ষার্থীদের 'নো কোটা, নো ডিসক্রিমিনেশন', 'সংবিধানের মূল কথা, সবার জন্য সমতা', 'বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই', 'সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে', 'মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার', 'জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে', 'সংগ্রাম না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ',- এই বাংলায় হবে না, বৈষম্যের ঠিকানা', 'আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার', 'আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই', 'এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন'সহ বিভিন্ন ধরনের ব্যানার, পোস্টার প্রদর্শন এবং কোটাবিরোধী এসব স্স্নোগান দেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল ও মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়ক দেড় ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ-সমাবশে করেছেন। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের আশেকপুর বাইপাস এলাকায় অবস্থান নিয়ে তারা এই কর্মসূচি পালন করেন। অবরোধের ফলে মহাসড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে উভয় পাশে অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। ছাত্র সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
শিক্ষার্থীরা অনেকে হাতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে 'বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই', 'একাত্তরের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই', 'কোটা প্রথা নিপাত যাক- মেধাবীরা মুক্তি পাক' ইত্যাদি স্স্নোগান দেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান বলেন, 'সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।'
শিক্ষার্থী আখতারুজ্জামান সাজু বলেন, ''চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির 'কবর রচনা' করতে আমরা একত্রিত হয়েছি। যেকোনো বাধাকে উপেক্ষা করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আমাদের দাবি একটাই, ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে। পরিপত্র পুনর্বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি) সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কোটা রেখে 'কোটা সংস্কার' করা।''
টাঙ্গাইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) লোকমান হোসেন জানান, '?শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-সমাবেশ শেষে মহাসড়ক থেকে সরে যাওয়ার পর মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাবি প্রতিনিধি জানান, মুক্তিযোদ্ধা কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে দেওয়া প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল বাতিল করে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। পরে দেড় ঘণ্টা সেখানে অবস্থান নেন। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
শনিবার সকাল ১০টা থেকে ১৭টি হল ও মেস থেকে সিনেট ভবন সংলগ্ন প্যারিস রোডে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। পরে বেলা সোয়া ১১টার দিকে মিছিল নিয়ে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন।
আন্দোলনকালীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও বিশ্ববিদ্যালয় ফিশারিস বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, 'আমি চাচ্ছি কোটা আন্দোলন সচল হোক। আমি প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন থেকে দেখতাম আমার বন্ধুরাও নিচ্ছে। আমারও যে প্রস্তুতি, তাদেরও সেই প্রস্তুতি। তবে আমি কোটাধারি হওয়ায় হয়ত যদি পরীক্ষা দেই, তাদের আগেই আমার চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই না, এমন বৈষম্য হোক। আমি চাই, কোটা না থাক। মেধার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হোক। আমি আপনাদের আন্দোলনের পক্ষে আছি। আন্দোলন সফল হোক।'
আন্দোলনের সংগঠক আলফাজ উদ্দীন বলেন, 'সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ তৎপর ছিল, আছে এবং থাকবে। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমান সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করার কোনো বিকল্প নেই।'
আন্দোলনের প্রধান সংগঠক আমানুলস্নাহ আমান বলেন, 'সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক হয়ে আমাদের আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলবে। সামনে আমরা আরও কর্মসূচি পালন করব। পরবর্তী নির্দেশনা পরে জানিয়ে দেওয়া হবে।'
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ইবি প্রতিনিধি জানান, শনিবার সকালে বৃষ্টি উপেক্ষা করে তৃতীয় দিনের মতো কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'র ব্যানারে বেলা ১১টায় ক্যাম্পাসের বটতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কসহ কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা।
এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, '২০১৮ সালে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল, সম্প্রতি হাইকোর্ট সেটা পুনর্বহাল করেছেন। আমরা হাইকোর্টের রায়কে প্রত্যাখ্যান করছি।' বক্তারা আরও বলেন, 'চাকরি পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষাসহ সবখানে কোটার ছড়াছড়ি। যার ফলে মেধাবীদের বঞ্ছিত করে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা এসব ক্ষেত্রে সুবিধা নিচ্ছে। আমরা এই বৈষম্য মানি না। আমাদের আন্দোলন একেবারে কোটা বাতিলের দাবিতে নয়। আমরা চাই, ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কোটা রেখে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে।'
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শাবি প্রতিনিধি জানান, হাইকোর্টের দেওয়া পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো আন্দোলনে নেমেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার বিকালে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এতে মহাসড়কের দুই পাশে প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে আটকে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, 'কেন স্বাধীন বাংলাদেশে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোটা নিয়ে বৈষম্যের স্বীকার হবে? প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ যদি কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, মেধাবী শিক্ষার্থীরা কী করবে? শিক্ষার্থীদের পক্ষে এমন অবহেলা এবং বৈষম্য মেনে নেওয়া সম্ভব না। তাই ২০১৮ সালে কোটা নিয়ে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, তা বহাল রাখতে হবে। যতক্ষণ না ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল থাকছে এবং কোটাব্যবস্থা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই আন্দোলন চলবে।'
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পাবনা ও পাবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় বাতিল এবং কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে পাবনা-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্বিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বর থেকে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা। এরপর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন পাবনা-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন ধরনের ব্যানার, পোস্টার প্রদর্শন এবং কোটাবিরোধী স্স্নোগান দেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, 'বৈষম্যমূলক কোটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ইতোপূর্বেও সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। যে বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই বৈষম্য আমরা মেনে নেব না।'
তারা আরও বলেন, 'আমরা কোটাব্যবস্থা বাতিল চাই না, কোটার সংস্কার চাই। যারা কোটা পাওয়ার অধিকার রাখে, তাদের অবশ্যই সেই অধিকার দেওয়া হোক। কিন্তু অতিরিক্ত কোটা প্রদানের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মেধাবীদের বঞ্চিত করার সুযোগ আমরা মেনে নিতে পারি না। কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করে ২০১৮ সালে জারিকৃত পরিপত্র পুনর্বহালের দাবি জানাই।'
এ সময় শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বেরোবি প্রতিনিধি জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলসহ চার দফা দাবিতে প্রায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। শনিবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরে প্রথমে বিক্ষোভ করেন তারা। এরপর বিক্ষোভ মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্কের মোড় হয়ে রংপুর নগরীর প্রবেশদ্বার মডার্ন মোড়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় রাস্তার ?দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাকের হোসেন বলেন, 'আমাদের ওপর হাইকোর্ট যে রায় চাপিয়ে দিয়েছেন, আমরা সেই রায় মানি না। যারা কোটাধারী মেধাবী পরিচয় দিতে চান, তাদের বলতে চাই, এই পরিচয় খুবই লজ্জার। কোনো বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকতে পারে না। তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার যেখানে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল হাইকোর্ট কেন সেই কোটাকে আবার পুনর্বহাল করল, আমরা জানি না। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের দাবি না মানা হবে ততক্ষণ আমরা রাজপথ ছাড়ব না।'
অন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শামসুর রহমান সুমন বলেন, 'এই বৈষম্য আমরা কখনো মানব না। ২০১৮ সালে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সে সময় কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। কিন্তু আজকে হাইকোর্ট সেই কোটা পুনর্বহাল করেছেন। হাইকোর্টের রায়কে প্রত্যাখ্যান করছি। সব যৌক্তিক আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দাবি না মানলে বেরোবির শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়বে না।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানববন্ধন
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জানান, কোটা সংস্কার ও কর্মসংস্থানের দাবিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব চত্বরে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম মুনতাসির বলেন, 'আজকে কোটা থাকার কথা ছিল অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর। অথচ আজকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ ভাগ নিয়োগ হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা নেওয়া হচ্ছে, তারা কি অনগ্রসর জাতি? যদি মেধাবীদের দেশে রাখতে চান, তাহলে অবশ্যই এই কোটা প্রথা বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে কোটা প্রথা নিয়ে যে পরিপত্র জারি হয়েছিল, সেটি বহাল করতে হবে। কোটা বিষয়ে দাবি না মানা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বৃহৎ পরিসরে আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।'
এশিয়া ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সানিউর রহমান বলেন, 'কোটা সংস্কার করে যোগ্য ও মেধাবীদের যোগ্য জায়গায় অধিষ্ঠিত করতে হবে। উপজাতি কোটা ও প্রতিবন্ধীদের কোটায় কোনো সমস্যা নেই। কোটার হার কেন শত ভাগের অর্ধেকের বেশি হবে?'
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বিগ্রেডের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নাসির মিয়া, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূর, খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক নিহার রঞ্জন সরকার প্রমুখ।
চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা ভেঙে নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে মিছিল নিয়ে দুই নম্বর গেট এলাকার গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এতে নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যান চলাচলে করতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে।
শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলে করে শিক্ষার্থীরা ষোলশহর নামেন। সেখানে তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে বিভিন্ন স্স্নোগান দিতে থাকেন। পুলিশ একপর্যায়ে তাদের স্টেশন থেকে সড়কে নামতে না দিলে তারা পুলিশের বাধা ভেঙে সড়কে নেমে আসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান বলেন, 'সরকারি চাকরিতে কোটার ফলে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেধা থাকার পরও যোগ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মূলত আমরা সব ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা প্রত্যাহার করা জন্য এই আন্দোলন করে যাচ্ছি।'
খুলনায় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ
খুলনা অফিস জানায়, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। শনিবার বিকাল ৩টায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। তাদের কর্মসূচিতে খুলনার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
নগরীর শিববাড়ি মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে খুলনা-যশোর মহাসড়ক, শিববাড়ি-সোনাডাঙ্গা সড়ক ও শিববাড়ি-ময়লাপোতা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় যানজটের। শিক্ষার্থীরা '১৮ এর হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার', 'বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই', 'কোটা দিয়ে বৈষম্য নয়, বৈষম্যমুক্ত দেশ চাই' ইত্যাদি স্স্নোগান দেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজাদ মিয়া ও আবির হাসান বলেন, 'কোটা বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। সাংবিধানিক দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে এসেছেন। আমরা আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখব।'