বাংলাদেশ যে চারটি বিষয় চাইতে পারে

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এবার অগ্রাধিকার পাবে 'বাংলাদেশের উন্নয়ন'

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিং যাচ্ছেন। ভারত সফরের পরপরই দ্বিপাক্ষিক চীন সফরটিকে ভূরাজনৈতিক অবস্থান আর অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য বেশ 'তাৎপর্যপূর্ণ' হিসেবে দেখা হচ্ছে। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা কিংবা কতগুলো চুক্তি-সমঝোতা হবে সেটি জানায়নি। তবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য এই সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এক কথায় জানান, চীন সফরে অগ্রাধিকার পাবে 'বাংলাদেশের উন্নয়ন।' চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বহুমাত্রিক। একক দেশ হিসেবে চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে এবং গত কয়েক বছর ধরে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও চীন বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলার ক্লাবের সদস্য। অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী আসন্ন চীন সফরে বেশকিছু বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি বলেন, 'চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা মাত্রা আছে। চীনে আমাদের অনেক ছাত্ররা যান। সুতরাং শিক্ষা, অবকাঠামো কালচারাল এক্সচেঞ্জ, আমাদের বাণিজ্য বিনিয়োগ সুবিধা এসব বহুমাত্রিক একটা আলোচনা হবে বলে মনে হচ্ছে'। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতার স্তরে উন্নীত হয়। এবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ঢাকা-বেইজিং দ্বীপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন কী মাত্রা যুক্ত হয় এবং চীনের বৈশ্বিক রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ কীভাবে কতটা যুক্ত হয়, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। বাংলাদেশের এজেন্ডা :এদিকে, ভারত সফরের পর আসন্ন চীন সফরে তিস্তা প্রকল্প, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য চীনের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি আলোচিত হবে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, চীনের কাছে টাকা আছে যেটি বাংলাদেশের দরকার। তিনি জানান, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে রাজনৈতিক দিক থেকে চীনকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে বাংলাদের অবস্থান কী সেটি তুলে ধরা হতে পারে। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে যেহেতু চীনের সম্পর্ক ভালো তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের সহযোগিতা বাংলাদেশ চাইবে। তিনি আরও বলেন, 'আমরা তাদের বলতে পারি, কারণ চায়নিজদের সঙ্গে মিয়ানমারের যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক, তাদের বলতে পারি তোমরা আমাদের এ ব্যাপারে সাহায্য কর। যাতে এটা আমরা থ্রম্ন ডায়ালগ অ্যান্ড ডিসকাশন এই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারি। আরেকটা হলো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। সেটার জন্য এখানে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে কীভাবে আসতে পারে। আমরা চাই তারা প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করুক।' বাংলাদেশ চীনের কাছে কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরে আশ্বস্ত করবে বলেও মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, আমরা এ এলাকায় কোনো ডিফেন্স প্যাক্ট পছন্দ করি না, আমরা চাই উন্নয়ন। তিনি বলেন, চীনের অধিকাংশ বাণিজ্য হয় ভারত মহাসাগর দিয়ে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মনে করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল হবে সবার জন্য উন্মুক্ত এবং সেটি এ অঞ্চলের সব দেশের উন্নতির জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে হবে। মোমেন বলেন, 'আমরা কোনো দেশকে আটকাতে চাই না। অন্যরা চায় যে কোনো একটা দেশের মূলত চায়নাকে কনটেন্ট করা, আমরা সে লাইনে না।' অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, চীন সফরে যেসব আলোচনা হবে এবং সমঝোতা স্মারক সই হবে সেটা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'পার্টিকুলারলি বাংলাদেশের যে ভূ-রাজনীতিক যে অবস্থান এটাতে কিন্তু চীন একটা বড় ধরনের পার্টনারশিপের সুযোগ দেখে। দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের যে পরিকল্পনা আছে সমন্বিত উন্নয়নের, সেখানে চীনকে পার্টনার করে কীভাবে সামনের দিকে আমরা যেতে পারি সেটা নিয়ে আমার মনে হয় আলাপ-আলোচনা হবে।' মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২৬-এর নভেম্বরে আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে যাব তারপরও যেন চীন আমাদের শূন্য শুল্ক বাজার সুবিধাটা দেয় এটা একটা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, 'আরেকটা হতে পারে আমরা একটা ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের আলোচনা শুরু করতে পারি বা কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ যেটা আরও বৃহত্তর পরিসরে।' আলোচনায় তিস্তা প্রকল্প এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর চীন সফরে তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং বাস্তবায়নে কোনো দেশের সহযোগিতা নেওয়া হবে সে প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তিস্তা প্রকল্পে ভারতের প্রস্তাব সামনে আসার পর এ প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটির বাংলাদেশ জানাতে পারে এবারের শীর্ষ বৈঠকে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ মনে করেন, বাংলাদেশ চাইলে উভয় দেশকে তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত করতে পারে। তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার এবং চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ বড় অঙ্কের বিনিয়োগ পায়। তিনি আরও বলেন, 'ভারতকে খুশি রাখা আমার জন্য জরুরি, চীনকেও খুশি রাখা জরুরি। সুতরাং এমন হতে পারে যেহেতু প্রকল্পটা বড় সেজন্য প্রকল্পের কিছু অংশ আমরা ভারতকে করতে অনুরোধ করতে পারি এবং কিছু অংশ চীনকে। এগুলো হতে পারে। এসব ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন রকমের ধ্যানধারণা কী আছে চীন কীভাবে চিন্তা করছে সেসব নিয়ে আলোচনা হবে।' সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই তিস্তা প্রকল্প নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি আরও বলেন, 'চাইনিজরা বলছে আমরা ওখানে টাকা দিতে পারি অ্যারাউন্ড আটশ মিলিয়ন ডলারের মতো মনে হয়। তার ফলে ভারত এখন বলছে যে আমরা তোমাদের সাহায্য করতে পারি। যেই করুক আমাদের কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটি নাই।' তিনি মনে করেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হবে এবং চীনের দিক থেকে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হতে পারে। তবে বিষয়টি নিয়ে খুব দ্রম্নত কিছু হবে বলে মনে হয় না। অবকাঠামো এবং ঋণ চাহিদা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের সময় ২৭টি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। এতে সরকারের সঙ্গে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো অনুদান, ঋণ এবং প্রাইভেট সেক্টরে আরও কিছু সমঝোতার আওতায় সব মিলিয়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রম্নতি এসেছিল। যদিও এই পরিমাণ ঋণ বা অর্থ বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে নিতে পারেনি। তবে সেই সমঝোতার আলোকে বাংলাদেশে চীনের টাকায় বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, এবার চীন সফরে সড়ক, সেতু ও রেলের আরও বেশকটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনকে পাশে চাইবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চীনের কাছে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইতে পারে বাংলাদেশ। চীনের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট ঘাটতি পূরণের জণ্য ঋণ সুবিধা নিয়ে আলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে সড়ক ও রেল মন্ত্রণালয়ের ৯টি প্রকল্প অর্থায়ন প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে যেখানে পদ্মাসেতুর রেল সংযোগের সঙ্গে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোরেলের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের অর্থায়ন চাওয়া হতে পারে বলেও জানা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যদি ইউয়ানে করতে পারি তাহলে আমাদের সুবিধা হবে যে ফরেন কারেন্সির ব্যবহারটা কম করে বাণিজ্য করতে পারব। এরকম একটা সমঝোতা আসতে পারে। আবার একটা বাজেট সাপোর্ট আসতে পারে। শোনা যাচ্ছে যে ৫ বিলিয়ন ডলারের একটা বাজেট সাপোর্ট আমরা চাইতে পারি। সেইটা হলে বর্তমান অবস্থায় এটা আমাদের একটা বড় ধরনের স্বস্তি দেবে।' চীন সফরে এবার বাংলাদেশ ঋণের সুদহার কমানোর একটা প্রস্তাব দিতে পারে বলে ধারণা করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, 'আগেরবার যখন প্রধানমন্ত্রী চীন গিয়েছিলেন তখন চীন সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন যে আমরা বেশি ইন্টারেস্ট দিতে পারব না। গরিব দেশ আমরা। তারা রাজি হয়েছিল তারা একটা ক্যাপ দিয়েছিল যে কোনোভাবেই দুই শতাংশের বেশি চার্জ করবে না। এটা আমরা এক শতাংশ চেয়েছিলাম। আমরা হয়তো সেটা আবার প্রস্তাব দিতে পারি যে তোমরা এটা কমাও।' চীনের ঋণ নিয়ে সতর্কতা বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার তালিকায় চীনের অবস্থান এখন শীর্ষ পাঁচে উঠে এসেছে। এ ছাড়া দ্বীপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার তালিকায় জাপান ও রাশিয়ার পরই চীনের অবস্থান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের পর থেকে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ দ্রম্নত বেড়েছে। গত চার অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে চীন থেকে। এবারও অনেক বড় প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। চীনের ঋণ নিয়ে বিপদের আশঙ্কা এবং বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে অর্থনীতিবিদরা চীনের ঋণ নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং ঋণ নিয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের যেমন একটা সতর্কতা দেখা যায়, তেমনি প্রতিবেশী দেশ এবং পশ্চিমা দেশগুলো সতর্ক দৃষ্টি রাখে যে বাংলাদেশ চীননির্ভর হয়ে পড়ছে কী না সে বিষয়ে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ ব্যাপারে বলেন, বাংলাদেশ ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে চীনকে পাশে দরকার বাংলাদেশের। তিনি আরও বলেন, 'চায়নার সুবিধা হচ্ছে দে হ্যাভ দ্য মানি, সারপস্নাস মানি। আর দেখেন ভারতও কিন্তু চায়নার থেকে কর্জ নেয়। অন্যরা কর্জ নিলে তাদের গায় জ্বালা করে, কিন্তু তারা নিজেরা নেয়।' মোমেন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ভারতে গিয়েছিলেন আমার মনে হয় একটা সমঝোতা হয়েছে। তার ফলে এবারের চায়না ভিজিটটা খুব ব্যঞ্জনাময় খুব ইমপর্টেন্ট হবে। আমরা হয়তো অনেক সহায়তা পাব চায়না থেকে।' সূত্র: বিবিসি বাংলা