সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অমর একুশে হল থেকে আন্দোলনের নেতা সারজিস আলমকে বের করে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী কয়েকজন নেতা তাকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এদিকে গত কয়েকদিনে কোটার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটছে নানা ঘটনা। আন্দোলনকারীরা রাজধানীর শাহবাগ ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ ও অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুক্রবার টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে, শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে তাদের সমর্থন জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী চলমান আন্দোলনের অন্যতম নেতা সারজিস আলমকে ঢাবি অমর একুশে হল থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী কয়েকজন নেতা বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা জানাজানি হলে একুশে হলসহ ঢাবির অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে তা করতে পারেননি অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারা। সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তারা সারজিসের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
সারজিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি পঞ্চগড় জেলায়। তিনি ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে অমর একুশে হল ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে সারজিসকে হলছাড়া করার চেষ্টার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই খবরে অমর একুশে হলের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে একুশে হলের পাশাপাশি অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়। তখন একুশে হলের অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারা সারজিসের কাছে ক্ষমা চান। বিক্ষোভ চলাকালে দিবাগত রাত একটার দিকে একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ ঘটনাস্থলে আসেন। সারজিস হলে থাকবেন বলে তিনি আশ্বস্ত করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শান্ত হন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সারজিসের সহযোগীরা তাকে তার হলের কক্ষে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
ঘটনার বিষয়ে মধ্যরাতে সারজিস সাংবাদিকদের বলেন, তার রুমমেটকে হল শাখা ছাত্রলীগে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতা বলেন, সংগঠনের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা এসেছে, তিনি যেন বৃহস্পতিবারের মধ্যে হল ছেড়ে যান। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তিনি। পরে তিনি সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের কাছে জানতে চান, এমন কিছু বলা হয়েছে কি না। তারা 'হঁ্যা' সূচক জবাব দেন। এই উত্তর পেয়ে তিনি কক্ষে এসে ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। কারণ, তিনি চাননি কোনো ঝামেলা হোক। হল ফটকে এসে দেখেন, পাঁচ থেকে সাতশ' শিক্ষার্থী দাঁড়ানো। তারা তাকে যেতে দিচ্ছিলেন না। কারণ, তিনি ছাত্রসমাজের একটা যৌক্তিক দাবির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছেন। খবর পেয়ে আশপাশের হল থেকে শিক্ষার্থীরা আসেন।
সারজিসের ভাষ্য, একপর্যায়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। জানতে চাওয়া হয়, হল শাখার কোন শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা তার সঙ্গে এই কাজ করেছেন। তাকে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চান। তারা স্বীকার করেন, ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না। তারা তাকে হল থেকে বের করে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'কোনো শিক্ষার্থীর আবাসিক হলে থাকা না-থাকাটা হল প্রশাসনের বিষয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করার সাংগঠনিক নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ডে সংগঠনের নেতাকর্মীদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।'
একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ ইশতিয়াক মঈন সৈয়দ বলেন, 'একটা ভুল-বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিলেন। পরে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি সমাধান করেছি। সারজিসকে হলের কক্ষে তুলে দিয়ে এসেছি।'
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল ও মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) ক্যাম্পাস। শুক্রবার সকাল ১০টায় তৃতীয় একাডেমিক ভবনের সামনে থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটক হয়ে প্রথম ফটকে অবস্থান নেন। প্রথম ফটকের সামনে দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়ে নানা স্স্নোগান দেন এবং সেখানে সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিএমবি বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীরা কখনো সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলন করতে চাই না, আমরা পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু আমাদের কিছু করার নাই। কারণ যে পরিমাণ কোটা, তাতে দেশের মেধাবীরা চাকরি না পেয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে, দেশে সরকারি চাকরি করার আগ্রহও হারাবে।'
সমাবেশে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তৌকির আহমেদ বলেন, 'বৈষম্যমূলক কোটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। আমরা ইতোপূর্বেও সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এ বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।'
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রাকিব বলেন, 'এই আন্দোলন সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন না, এই আন্দোলন আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের আন্দোলন। যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলন। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে চাই।'
দাবি না মানা হলে আজ শনিবার বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করার হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনকারীরা।
এদিকে, শুক্রবার ঢাবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান, যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান ও অধ্যাপক আবদুস সালাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারিকৃত সরকারি পরিপত্রের অংশবিশেষ অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। একইসঙ্গে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের চলমান আন্দোলনের প্রতি আমরা সমর্থন জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের অবদানের স্বীকৃতি এবং সম্মান জানানোর অন্য আরও অনেক বিকল্প আছে। সে বিকল্পগুলো বংশ পরম্পরায়ও চলতে পারে। কিন্তু তা না করে চাকরিতে বংশ পরম্পরায় ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখা অযৌক্তিক বলে মনে করি আমরা। কারণ এর ফলে বেকার সমস্যা যেমন প্রবল হবে, তেমনি তুলনামূলকভাবে যোগ্য ও মেধাবীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এটি এক ধরনের বৈষম্যও বটে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গেও তা সংগতিপূর্ণ নয়।'
বিজ্ঞপ্তিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রতিবাদে চাকরিপ্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীদের চলমান যৌক্তিক ও ন্যায্য আন্দোলনকে সম্মান জানিয়ে কোটাব্যবস্থা বাতিলসহ অবিলম্বে তাদের চার দফা দাবি পূরণের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
হাবিপ্রবি প্রতিনিধি প্রতিনিধি জানান, চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুক্রবার দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) প্রধান ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
কর্মসূচি থেকে 'দাবি মোদের একটাই, কোটার সংস্কার চাই', 'কোটা না মেধা? মেধা মেধা' ইত্যাদি স্স্নোগান দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
সংহতি জানাবে বিএনপি
এদিকে, সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাবে বিএনপি। এ বিষয়ে দলের অবস্থান জানাতে আজ শনিবার সকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি ভার্চুয়াল সভা হয়। বৈঠকে কোটাবিরোধী আন্দোলন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ ইসু্যতে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় দলের হাইকমান্ড। এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া দেশের বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দলের চেয়ারপারসন অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে। এছাড়া দুর্নীতিবিরোধী ও চুক্তি-সমঝোতার প্রতিবাদে কর্মসূচি পালনের ভাবনা আছে দলে।